ট্রেন, অটোরিকশা, লঞ্চ ও ঘোড়ার গাড়িতে দুর্ভোগের যাত্রা
দিপু রহমান (৫০) চাকরি করেন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বাস ও ট্রেনের টিকিট না পেয়ে ভেঙে ভেঙে ট্রেন, অটোরিকশা, লঞ্চ ও ঘোড়ার গাড়িতে করে মঙ্গলবার বাড়ি ফিরতে হয়েছে তাঁকে। পথে পথে পোহাতে হয়েছে দুর্ভোগ।
মঙ্গলবার দুপুরে ট্রেনে করে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ স্টেশনে নামেন দিপু রহমান। এরপর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে বাহাদুরাবাদ ঘাটে যান। সেখান থেকে দুপুরে লঞ্চে করে বালাসি-বাহাদুরাবাদ নৌপথ ধরে গাইবান্ধার বাগুরিয়া ঘাটে আসেন। এরপর বাগুরিয়া নৌঘাট থেকে ঘোড়ার গাড়িতে চার কিলোমিটার বালুচর পাড়ি দিয়ে বালাসিঘাটে পৌঁছান। অবশেষে অটোরিকশায় বিকেলে গাইবান্ধা শহরের সরকারপাড়ার বাড়িতে পৌঁছান তিনি।
দিপু রহমানের মতো অনেকেই ঢাকা থেকে ট্রেন ও বাসের টিকিট না পেয়ে এভাবে দুর্ভোগ নিয়ে গাইবান্ধায় পৌঁছান। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ বাধ্য হয়ে লঞ্চের বদলে নৌকায় করে বাগুরিয়া ঘাটে আসেন। বর্ষায় সময় চার কিলোমিটার বালুচরের পথটায় পানি থাকে। তখন বালাসিঘাট পর্যন্ত নৌযান চলাচল করে। শুকনা মৌসুমে বালুচরের কারণে দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়।
দিপু রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা থেকে বাগুরিয়াঘাট পর্যন্ত আসতে তেমন কষ্ট হয়নি। তবে নদীর ঘাট থেকে বালুচর পার হতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এমনিতে প্রচণ্ড গরমে ওষ্ঠাগত জীবন। এর মধ্যে কেউ ঘোড়ার গাড়ি, কেউ ট্রাক্টরে (কাকড়া) বালুপথ পার হচ্ছেন। চার কিলোমিটার পথে লু হাওয়া। বালুঝড়ের বালুতে চোখমুখ ভরে গেল।’
একই রকম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে গাইবান্ধা থেকে জামালপুর ও ঢাকায় যেতে। জামালপুর জেলা শহরের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম (৪৮) গাইবান্ধা শহরের ডিবি রোডে ব্যবসা করেন। তিনিও ঈদ করতে মঙ্গলবার দুপুরে জামালপুরে যান।
আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘গাইবান্ধা শহর থেকে অটোরিকশায় পাঁচ কিলোমিটার পথ পার হয়ে বালাসিঘাটে গিয়েছি। এরপর ট্রাক্টরে বালুপথ পার হয়ে বাগুরিয়ায় আসি। কষ্টের কথা কী বলব, বালুর সঙ্গে যুদ্ধ করে বাড়ি ফিরলাম।’ দিপু রহমান ও আমিনুল ইসলামের মতো অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা বলে দুর্ভোগের একই বর্ণনা পাওয়া গেল।
মঙ্গলবার বিকেলে গাইবান্ধা শহর থেকে বাগুরিয়াঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, লঞ্চে উপচেপড়া ভিড়। ঢাকা থেকে আসা ঘরমুখী মানুষ তড়িঘড়ি করে লঞ্চ থেকে নামছেন। কেউ কেউ লঞ্চের জন্য অপেক্ষা করছেন। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় পারাপার হচ্ছেন। নৌকার ওপর নেই ছাউনি ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। কয়েক দিন ধরেই একই অবস্থা চলছে।
গত বছরের ৯ এপ্রিল বালাসি-বাহাদুরাবাদ লঞ্চ চলাচলের উদ্বোধন করেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এর পর থেকে তিনটি লঞ্চ অনিয়মিত চলছে। পাশাপাশি ছোট-বড় ১৫-২০টি নৌকায় করা হচ্ছে যাত্রী পারাপার। ব্রহ্মপুত্র নদে নাব্যতা হ্রাসের কারণে এ অবস্থা। ঈদ সামনে রেখে লঞ্চ চললেও নৌকায়ও ঘরমুখী যাত্রীর চাপ বেড়েছে।
ফুলছড়ি উপজেলার সমিতির বাজার গ্রামের মেহেদী মিয়া বলেন, ঈদে মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বেশি। ট্রেনের টিকিট পাওয়া দুষ্কর। এ কারণে ঘরমুখী মানুষ লঞ্চ ও নৌকার ওপর নির্ভরশীল। ঈদের কারণে লঞ্চ ও নৌকায় ঝুঁকি নিয়ে যাত্রী পার করা হচ্ছে। ভাড়া নেওয়া হচ্ছে বেশি।
গাইবান্ধা বালাসি-বাহাদুরাবাদ লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ঈদ সামনে রেখে প্রতিদিন বালাসিঘাট থেকে সকাল ৯টা, বেলা ১১টা ও ২টায় লঞ্চ ছেড়ে যায়। জনপ্রতি ভাড়া ১২০ টাকা। প্রতিটি লঞ্চ ১৫০-২৫০ আসনবিশিষ্ট। যেতে সময় লাগে পৌনে দুই ঘণ্টা ও আসতে আড়াই ঘণ্টা। কিন্তু নাব্যতা সংকটের কারণে নিয়মিত লঞ্চ চালানো যাচ্ছে না। বিআইডব্লিটিএ কর্তৃপক্ষের কাছে ড্রেজার চাওয়া হয়েছে। ড্রেজিং ছাড়া এ রুটে লঞ্চ চালানো সম্ভব নয়।
গত বছরের ডিসেম্বর থেকে বালাসিঘাট থেকে বাগুরিয়া পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার বালুচর জেগে ওঠে জানিয়ে ফুলছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম সেলিম পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, গাইবান্ধা থেকে বালাসি-বাহাদুরাবাদ নৌপথ হয়ে ঢাকা যেতে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা সময় লাগে। অথচ সড়কপথে লাগে ৯ ঘণ্টা এবং রেলপথে ১০ ঘণ্টা। এ নৌপথে বর্ষা মৌসুমে প্রায় ছয় মাস নৌকা চলে। বাকি ছয় মাস প্রায় শুকনা মৌসুম। এ সময় চার কিলোমিটার ঘোড়ার গাড়িতে এবং বাকি অংশ শ্যালোচালিত নৌকায় পার হতে হয়।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, ব্রিটিশ আমলে ১৯৩৮ সালে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখঘাট-জামালপুরের বাহাদুরাবাদ নৌপথ চালু হয়। তখন উত্তরাঞ্চলের আটটি জেলার মানুষ ট্রেনযোগে তিস্তামুখঘাটে যেতেন। এরপর তিস্তামুখঘাট-বাহাদুরাবাদ নৌপথে ফেরি পার হতেন। এরপর বাহাদুরাবাদে গিয়ে ট্রেনে উঠে ঢাকায় যেতেন।
১৯৯০ সালে নাব্যতা-সংকটের কারণে তিস্তামুখ থেকে ঘাট উপজেলার বালাসিতে স্থানান্তর করা হয়। এ জন্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ত্রিমোহিনী থেকে বালাসি পর্যন্ত নতুন প্রায় ৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে ১৯৯৮ সালের জুন মাসে যমুনা বহুমুখী সেতু চালু হয়। ফলে ২০০০ সাল থেকে এ নৌপথে রেলওয়ের ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
সম্প্রতি বালাসি-বাহাদুরাবাদ নৌপথে লঞ্চ সার্ভিস চালুর জন্য স্থানীয় জনগণের দাবির মুখে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) উভয় পাশে ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নৌ টার্মিনাল নির্মাণ করে। এতে ২২ বছর পর গত বছরের ৯ এপ্রিল গাইবান্ধাবাসীর বহু প্রত্যাশিত লঞ্চ সার্ভিস চালু হয়।