৬ হাজার একর বন দখল

দুই হাজার ৪৪৩ জন দখলদারের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির নেতাদের নামও রয়েছে।

  • দিনাজপুরে মোট বনভূমি আছে ১৯ হাজার ১১২.২৩ একর।

  • সর্বনিম্ন ৫ শতক থেকে শুরু করে ১০ একর পর্যন্ত বনের জমি দখল।

দিনাজপুরে বন বিভাগের ৬ হাজার ৯৬ একর জমি স্থানীয় ব্যক্তিদের দখলে চলে গেছে। এসব জমিতে কেউ বসতবাড়িসহ নানা স্থাপনা তুলেছেন, কেউ কেউ চাষাবাদ করছেন। দখলে থাকা জমি উদ্ধার করতে যাওয়া বন বিভাগের কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটছে।

বন বিভাগের তথ্য বাতায়নে সম্প্রতি বনের জমি দখলকারীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এসব দখলকারীকে উচ্ছেদের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে দিনাজপুর বন বিভাগ। দ্রুতই অভিযান শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ১৯ হাজার ১১২ দশমিক ২৩ একর বনভূমি রয়েছে। চরকাই, মধ্যপাড়া, দিনাজপুর সদর ও ঠাকুরগাঁও—এই চার রেঞ্জের অধীনে ১৫টি বিটে ভাগ করে কার্যক্রম পরিচালিত হয়। দখল হয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ মোট বনভূমির প্রায় ৩২ শতাংশ। তালিকায় দখলদারদের সংখ্যা দুই হাজার ৪৪৩। তাঁদের দখলে সর্বনিম্ন ৫ শতক থেকে শুরু করে ১০ একর পর্যন্ত বনের জমি রয়েছে। দখলদারদের তালিকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের নেতাদের নাম পাওয়া গেছে।

জেলায় সবচেয়ে বেশি বনভূমি দখল হয়েছে নবাবগঞ্জ উপজেলায়। এখানে ৬৫৪ জন দখলকারী প্রায় ৩ হাজার ৯৫২ একর জমি দখলে নিয়েছেন।

নবাবগঞ্জ উপজেলার চরকাই রেঞ্জের বিট কর্মকর্তা নিশিকান্ত মালাকার বলেন, গত ৪ বছরে ওই বিটে ২২০ একর জমি দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। বনের পাশে অবৈধভাবে স্থাপন করা ইটভাটাও উচ্ছেদ করা হয়েছে। সম্প্রতি হরিপুর বিটে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গিয়ে দখলকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে নবাবগঞ্জ থানা ও মধ্যপাড়া রেঞ্জের কর্মকর্তাসহ আটজন গুরুতর আহত হন বলে বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে দখলদারদের তালিকায় দুই শতাধিক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের নাম থাকা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন বাংলাদেশ আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন। তিনি বলেন, এই বন রক্ষা করেছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা। বন ঘিরেই তাদের জীবন ও জীবিকা। তারা ৫-১০ শতক জমিতে বসতবাড়ি করে আছে। যদি তাদের উচ্ছেদ করতেই হয়, অবশ্যই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে।

পার্বতীপুর উপজেলার দক্ষিণ হরিরামপুর মৌজায় প্রায় ৩০ একর জমি দখলে নিয়ে কৃষিকাজ করছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম বলেন, পৈতৃক সূত্রে জমিগুলোর মালিকানা তাঁদের। বনের জমি দখলের কোনো ঘটনা নেই।

দখলদারদের তালিকায় নবাবগঞ্জ উপজেলার আফতাবগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত বিনোদন পার্ক স্বপ্নপুরীর মালিক দেলোয়ার হোসেনও রয়েছেন। ২০১৫ সালে বন বিভাগের ১০ একর জায়গার শতাধিক গাছ কেটে জায়গা দখলে নেওয়ার অভিযোগে বন কর্তৃপক্ষ স্বপ্নপুরীর ব্যবস্থাপকসহ ৫ জনের নামে মামলাও করে। তবে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বলেন, টেবিলে বসে কাগজে স্বাক্ষর করে মনগড়া প্রতিবেদন তৈরি করেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা। এই জমিগুলোর রেকর্ড, খাজনা-খারিজসহ যাবতীয় প্রমাণাদি তাঁদের আছে।

বিএনপির সমর্থক ঘোড়াঘাট পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিল ও প্যানেল মেয়র আবদুল কাদের উপজেলার সাহেবগঞ্জ মৌজায় ১ একর ৩৩ শতক জমি দখল করে চাতাল তৈরি করেছেন। তবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই মৌজার ২০৬ একর জমি সরকার ১৯৮৩-৮৪ সালে অবমুক্ত করেছে। পরে বন বিভাগ আপিল করলে উচ্চ আদালত থেকে আমরা রায় পাই। বন বিভাগ হেরে যায়। ওই এলাকায় বন বিভাগের কিছু গাছ রয়েছে। এখানে বনের জমি দখল করার কোনো ঘটনা নেই।’

দিনাজপুর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বশিরুল-আল-মামুন বলেন, বন বিভাগ জমিগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। চলতি বছরেই ১৫০ একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। এসব জবরদখলকারীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে করা ২৭৯টি মামলাও রয়েছে। গত তিন বছরে ৫১টি মামলা করা হয়েছে।