বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্রে ‘শয়তান দেহ পাবি, মন পাবি না’ নিয়ে ফেসবুকে সমালোচনা

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের মিডটার্ম পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ‘শয়তান দেহ পাবি, মন পাবি না’ বা ‘শয়তান দেহ পাবি, চিন্তা পাবি না’ উদ্ধৃতি উল্লেখ করে শিক্ষার্থীদের একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। ‘ব্রিটিশ হেজিমনি’র আলোকে সেটির বিস্তারিত বর্ণনা করতে বলা হয় প্রশ্নে। সেই প্রশ্নপত্রের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করার পর পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়েছে।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, হেজিমনি বোঝানোর জন্য সিনেমার এ ডায়ালগ বেছে নেওয়া সংগত নয়। শব্দগুলো সাধারণত নেতিবাচক আলোচনার জন্ম দেয়। অন্য উদাহরণের মাধ্যমেও বিষয়টি স্পষ্ট করা যেত। তা ছাড়া প্রশ্নপত্রে বাংলা ভাষা ইংরেজি শব্দে উল্লেখ করা কতটা যৌক্তিক, সেটিও বিবেচনার বিষয়।

প্রশ্নকর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মেহেদী হাসান বলছেন, প্রসঙ্গ না বুঝেই অনেকে যাঁর যাঁর জায়গা থেকে প্রশ্নটি নিয়ে সমালোচনা করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের বাংলাদেশ স্টাডিজ কোর্সের নির্দিষ্ট শিক্ষক নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষকের সংখ্যাও কম। এ জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হলেও মেহেদী হাসান বাংলাদেশ স্টাডিজের ক্লাস নেন। সংশ্লিষ্ট বিষয় হওয়ায় তিনি মিডটার্ম পরীক্ষার প্রশ্নটি করেন।

আলোচিত প্রশ্নপত্র
ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষার্থীরা জানান, গত বৃহস্পতিবার ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের বাংলাদেশ স্টাডিজ কোর্সের প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় মিডটার্ম পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষায় মূলত ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ হেজিমনির আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করতেই ‘শয়তান দেহ পাবি, মন পাবি না’ এবং ‘শয়তান দেহ পাবি, চিন্তা পাবি না’ উল্লেখ করে একটি প্রশ্ন করা হয়। প্রশ্নপত্রে বিষয়টি বিস্তারিত বর্ণনা করতে বলা হয় শিক্ষার্থীদের।

শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ওই প্রশ্নপত্রের একটি ছবি তুলে পোস্ট করেন। এরপর বিষয়টি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা।

আবু বকর সিদ্দিক নামের এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘উইকিপিডিয়া পড়া শিক্ষক আর তাতে অভ্যস্তরা সৃজনশীলতা বুঝবে না। এরা কূপমণ্ডূকতার চর্চা করেই যাবে। সবকিছু নিয়ে ট্রল করবে। বেকার আগডুম-বাগডুম লোক এরা।’ আরেক শিক্ষার্থী লেখেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যদি নৈতিকতা শিক্ষায় অবদান না রেখে অশ্লীলতা ছড়ান, এমন অপ্রীতিকর ভাবধারার প্রশ্ন করেন, সেটা জাতিকে পথভ্রষ্ট করার জন্য যথেষ্ট হতে পারে।’

সহকারী অধ্যাপক মেহেদী হাসান তাঁর করা প্রশ্নে কোনো সমস্যা আছে বলে মনে করেন না। তিনি দাবি করেন, ‘প্রশ্নে নেগেটিভ কিছু নেই। এটি কোট-আনকোটের মধ্যে আছে। যাদের পড়িয়েছি, সেখানে টেক্সট ডকুমেন্ট দেওয়া আছে। যারা হেজিমনি পড়েছে, তারা কোনো সমালোচনা করবে না। হয়তো যারা জানে না, তারা সমালোচনা করছে। ব্রিটিশ রাজরা কীভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে হেজিমনিকে প্রতিষ্ঠা করেছে, তার সঙ্গে লাইনটির যথার্থ উদাহরণ পাওয়া যাবে। এখনো প্রতিটি জায়গায় হেজিমনি আছে। এমনকি প্রশ্নপত্র নিয়ে যেটি হচ্ছে, সেটিও হেজিমনির বহিঃপ্রকাশ।’

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু জাফর মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে যেভাবে সমালোচনা করা হচ্ছে, সেটি খুবই দুঃখজনক। ওই প্রশ্ন করে শিক্ষক কোনো ভুল করেননি। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ শুধু ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়া নয়। গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা এবং তা বিতরণ করা। আর নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করার জন্য চাই মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও চিন্তার স্বাধীনতা। কিন্তু আমরা মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও চিন্তার স্বাধীনতা কী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিশ্চিত করতে পেরেছি? ওই প্রশ্নের সমালোচনার মধ্য দিয়ে আমাদের সেই দৈন্য ফুটে উঠেছে।’

আবু জাফর মিয়া বলেন, বাংলাদেশ স্টাডিজ কোর্সের পরীক্ষার প্রশ্নকর্তা শিক্ষক অবশ্যই বিষয়টি কোনো ঘটনা বা কনসেপ্টকে ভালোভাবে বোঝানোর জন্য ওই উদ্ধৃতির অবতারণা করেছেন। তিনি ক্লাসে পড়ানোর পর প্রশ্ন করেছেন। তিলকে তাল করে যদি এভাবে সমালোচনা করা হয় এবং একজন সম্মানিত শিক্ষকের সম্মানহানি করা হয়, তাহলে ক্লাসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাঠদান ও প্রশ্নপত্র তৈরি করা সত্যিই কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে।