দিনমজুর বাবার প্রতিবন্ধী সন্তান যেভাবে সংসারের হাল ধরেছেন

শিশুকাল থেকে জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন আনোয়ার হোসেন। বৃহস্পতিবার রংপুর নগরের মডার্ন মোড় এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

তিন মাস বয়সে দোলনা থেকে পড়ে দুই পা ভেঙে যায় আনোয়ার হোসেনের। বাবা দিনমজুর হওয়ায় আর্থিক দৈন্যের কারণে সন্তানের সুচিকিৎসা করাতে পারেননি। একসময় আনোয়ার আর স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারেন না। শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যান। দুই হাত মাটিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করতে থাকেন। এতে কিছু মানুষ তাঁকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ভিক্ষার ঝুলি রোজগারের পরামর্শ দেন। বিষয়টি তাঁর মনে দাগ কাটে, ভীষণ কষ্ট পান। ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেন।

হাঁটাচলা করতে না পারলেও কারও কাছে হাত পাতেননি আনোয়ার। কখনো বাবার পিঠে চড়ে, বন্ধুদের সাইকেলে করে স্কুল-কলেজ যেতেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় গ্রামের বাড়িতে টিনের চালা ঘরে ছোট ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। এখনো সেই কাজই করে চলেছেন। নিজের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়িয়ে আয় করছেন। সেই আয়ের টাকায় পুরো সংসারের খরচ চালাচ্ছেন।

অদম্য শারীরিক প্রতিবন্ধী আনোয়ার রংপুর নগরের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরদিঘর এলাকার দিনমজুর শাহজাহান আলীর ছেলে। তাঁর বর্তমান বয়স ২৩ বছর। পড়ছেন রংপুর সরকারি কলেজে বিএসএস শেষ বর্ষে। মা আনোয়ারা বেগম গৃহিণী। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় আনোয়ার।

২০০০ সালের ২৭ জুলাই জন্ম নেওয়া আনোয়ারকে গ্রামের শেখপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন দিনমজুর বাবা শাহজাহান আলী। এরপর গ্রামের নাজিরদিঘর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী কারমাইকেল কলেজে।

গত বৃহস্পতিবার আনোয়ারের সঙ্গে দেখা মিলল নগরের পার্ক মোড়ে। তিন চাকার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাসদৃশ বিশেষ যান নিয়ে তিনি গন্তব্যে ছুটছিলেন।আলাপকালে আনোয়ার বললেন, বাড়ির একটি গাছে মা দড়ি টাঙিয়ে বসার জন্য কাঠ দিয়ে একটি দোলনা বানিয়ে সেখানে তাকে দোল খাওয়াতেন। বাবা দিনমজুরির কাজে যান, যা আয় হয়, তাই দিয়ে চলে টানাপোড়েনের সংসার। ছোটবেলায় দোলনায় দোল খাওয়ার সময় পড়ে গিয়ে তাঁর দুই পা ভেঙে যায়। অর্থ না থাকায় চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। ফলে একপর্যায়ে পা দুটো ভাঁজ অকেজো হয়ে যায়। তিনি প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। গ্রামের মানুষ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে থাকেন। এভাবেই বড় হয়ে উঠতে থাকেন।

২০০০ সালের ২৭ জুলাই জন্ম নেওয়া আনোয়ারকে গ্রামের শেখপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন দিনমজুর বাবা শাহজাহান আলী। এরপর গ্রামের নাজিরদিঘর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী কারমাইকেল কলেজে। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বর্তমানে রংপুর সরকারি কলেজে বিএসএস শেষ বর্ষে পড়ছেন। তাঁর অদম্য ইচ্ছে পড়ালেখা করে উচ্চশিক্ষিত হবেন। পাশাপাশি মানুষের জন্য কাজও করবেন।

আনোয়ার সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলেন। কষ্ট করে বেড়ে ওঠার কাহিনির স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার পিঠে চড়ে স্কুলে যেতাম। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে স্থানীয় নাজিরদিঘর উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হই। গ্রামের মানুষজন হাসতেন, তাচ্ছিল্য করতেন। এমন কথাও বলতে শুনেছি, ভিক্ষা করলে টাকা রোজগার হবে। ধানের সময় ধান পাওয়া যাবে, আলুর সময় আলু ভিক্ষা পাওয়া যাবে। এসব কথা শুনে অনেক কেঁদেছি।’  

আনোয়ার বলেন, ‘সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাড়িতেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করি। এতে আয়রোজগার হতে থাকে। স্কুলের স্যাররাও আমার লেখাপড়ায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এখন প্রতিদিন সাতজন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়িয়ে রোজগার ভালোই হচ্ছে।’

২০১৮ সালে সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান একটি তিন চাকার হাতচালিত রিকশা দেন। ২২ হাজার টাকা খরচ করে রিকশাটি ব্যাটারিচালিত করেন আনোয়ার। এখন ব্যাটারিচালিত সেই রিকশা চালিয়ে ছুটে চলেন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। ১০ম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত গ্রুপভিত্তিক প্রাইভেট পড়িয়ে রোজগার করছেন টাকা। তাঁর জমানো টাকা দিয়ে দুই ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ চলানোর পাশাপাশি সংসারের হালও ধরেছেন। বোন পড়ছেন কারমাইকেল কলেজে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে তৃতীয় বর্ষে। সম্প্রতি তাঁর বিয়েও দিয়েছেন। ছোট ভাই শহরের মডেল কলেজে এইচএসসি শিক্ষার্থী।

দুই হাত মাটিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করতে হয় আনোয়ার হোসেনকে।বৃহস্পতিবার রংপুর নগরের মডার্ন মোড় এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো
নিজের চেষ্টা থাকলে কিছু করা সম্ভব, এটির বড় উদাহরণ আনোয়ার।
আবদুল মতিন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক, রংপুর

আনোয়ার যে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন, সেই নাজিরদিঘর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অত্যন্ত মেধাবী আনোয়ার। তাঁর অদম্য ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া করার। আমরা শিক্ষকেরা তাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করতাম। আজ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে না পারলেও সে কারও কাছে সাহায্য না চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তার কাছ থেকে অনেক শেখার আছে।’

আনোয়ার বলেন, নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবীর কাজও করছেন। কারও রক্তের প্রয়োজন হলে বিভিন্ন জায়গায় ফোন দিয়ে রক্ত সংগ্রহ করে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কারও সহযোগিতা ছাড়াই চলাফেরা করেন ও লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি করছেন অর্থ উপার্জন। এখন সবাই তাঁকে বাহবা দেন, সাহস জোগান।

রংপুর সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবদুল মতিন বলেন, নিজের চেষ্টা থাকলে কিছু করা সম্ভব, এটির বড় উদাহরণ আনোয়ার।

রংপুর সিটি করপোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সামসুল হক বলেন, আনোয়ার প্রতিবন্ধী হলেও সবাই এখন সবাই তাঁর প্রশংসা করেন। নিজের চেষ্টায় স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন।