একসময় অন্যের মাছ ধরে দিতেন, এখন হ্যাচারি মালিক হিসেবে পেলেন মৎস্য পদক

হ্যাচারি মালিক হিসেবে এবার জাতীয় মৎস্য পদক পেয়েছেন ময়মনসিংহের গৌরীপুরের যতীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ
ছবি: প্রথম আলো

স্বাধীনতার আগের কথা। গ্রামে তখন ভাতের খুব অভাব। পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে কিশোর বয়সে জাল নিয়ে বের হতে হতো যতীন্দ্র চন্দ্র বর্মণকে। বিলে মাছ ধরে সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে খাবার জুটত। এভাবে চলেছে জীবনের প্রায় ১২টি বছর। পরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষের পুকুরের মাছ ধরে দেওয়ার কাজ করেন কয়েক বছর। এর বিনিয়মে মাছ ও টাকা পেতেন। এরপর সাইকেলে করে গ্রামে গ্রামে মাছের পোনা বিক্রির কাজ করেন আরও কয়েক বছর।

সেই যতীন্দ্র গত ২৫ জুলাই জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন জাতীয় মৎস্য পদক। ইতালি সফরে থাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পদকটি গ্রহণ করতে না পারা তাঁর বড় আক্ষেপ। পদক পাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে পেয়েছেন আনুষ্ঠানিক সম্মাননা। এতে তিনি দারুণ খুশি।

যতীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ এখন ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার একজন সফল হ্যাচারিমালিক। পোনা উৎপাদনের স্বীকৃতিস্বরূপ এবার জাতীয় মৎস্য সপ্তাহে পেয়েছেন জাতীয় মৎস্য পদক-২০২৩। গৌরীপুর উপজেলার পৌর শহরের বাগানবাড়ি এলাকায় তাঁর বাড়ি। তবে নিজের হ্যাচারি গড়ে তুলেছেন গৌরীপুর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে।

শনিবার ওই হ্যাচারিতে গিয়ে দেখা যায়, নিজের পুকুরে শ্রমিকদের সঙ্গে মাছ ধরছেন যতীন্দ্র। তিনি বলেন, সেই কিশোরকাল থেকে পরিশ্রম করতে শুরু করেছিলেন। এখনো একই রকম পরিশ্রম করেন। প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা নিজের হ্যাচারিতে কাজ করেন। পরিশ্রমই মানুষকে সফল করে তুলে। বর্তমানে তাঁর হ্যাচারিতে ২০ থেকে ২২ শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন।

হ্যাচারি শুরুর গল্প জানতে চাইলে যতীন্দ্র বলেন, মাছ ধরা ও পোনা বিক্রির কাজ করে যখন সংসার চলছিল না, তখন একদিন নিজের বাড়ির পাশে ৫০০ টাকার বিনিময়ে এক বছরের জন্য একটি মজা পুকুর ইজারা নেন। পুকুরভর্তি ছিল কচুরিপানা। সেসব পরিষ্কার করে মাত্র ৫০০ গ্রাম পোনা ছেড়ে শুরু করেন ব্যবসা। ভালোই চলতে থাকে ওই ব্যবসা। কিছু টাকা জমা হয়ে গেলে সে টাকায় আরও বড় পরিসরে শুরু করেন পোনার ব্যবসা। পাশাপাশি গ্রাম থেকে মাছ কিনে সাইকেলে করে ময়মনসিংহ শহরে বিক্রির কাজও করতে থাকেন। ওই সময় জানতে পারেন, বাহাদুরপুর গ্রামে একজন একটি পুকুর বিক্রি করবেন। খুব অনুরোধ করে কয়েক দফায় টাকা পরিশোধের শর্তে পুকুরটি কিনে নেন তিনি। এর আরও কয়েক বছর পর ২০০৫ সালে বাহাদুরপুর গ্রামে গড়ে তুলে নিজের হ্যাচারি।

যতীন্দ্র পৌর শহরের যে বাড়িটিতে থাকেন, সেটা উপহার পেয়েছিলেন গৌরীপুরের জমিদারদের বংশধর রহিনীকান্ত লাহিড়ী চৌধুরীর কাছ থেকে। যতীন্দ্র ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো গান গাইতেন। আর রহিনীকান্ত গান শুনতে পছন্দ করতেন। তাঁদের মধ্যে গায়ক আর শ্রোতার একটা সুন্দর সম্পর্ক ছিল। সেই রহিনীকান্ত তাঁকে গৌরীপুর পৌর শহরের বাগানবাড়ি এলাকায় নিজের জমি দান করেছিলেন। পরে সেখানেই বাড়ি বানিয়ে থাকতে শুরু করেন যতীন্দ্র।

সংসারে স্ত্রী ছাড়া আছেন এক ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলে ব্যবসা করেন। আর দুই মেয়ে এখনো পড়াশোনা করছেন। গানের অভ্যাস এখনো ধরে রেখেছেন যতীন্দ্র। সময় পেলেই গান করেন।

ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিশ্রম করলে মানুষ কত দূর পৌঁছাতে পারে, তার দৃষ্টান্ত যতীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ। তাঁর জীবনসংগ্রামের কথা আমরা জানি। সে জন্য আমরা তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলাম। তাঁর জাতীয় মৎস্য পদকপ্রাপ্তিতে আমরা আনন্দিত।’