মানুষের টাকা নিয়ে সমবায় প্রতিষ্ঠান উধাও, কান্না থামছে না রোকেয়াদের

৩০ লাখ টাকা ধরা খেয়ে পথে বসে কান্না করছেন রোকেয়া বেগম। বুধবার বেলা পৌনে দুইটার দিকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার শিমুলকান্দি ইউনিয়নের চাঁনপুর বাজারেছবি: সুমন মোল্লা

কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার শিমুলকান্দি ইউনিয়নের চাঁনপুর বাজারে সড়কের পাশে বসে কান্না করছিলেন এক গৃহবধূ। বুধবার বেলা পৌনে দুইটার দিকে ওই গৃহবধূর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর নাম রোকেয়া বেগম (৪০)। তিনি চাঁনপুর মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানে মুনাফার আশায় ৩০ লাখ টাকা জমা রেখেছিলেন। সেই কার্যালয়ে এখন তালা ঝুলছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. শাহ আলমও উধাও। এত টাকা খোয়ার আশঙ্কায় কান্না থামছেই না তাঁর।

রোকেয়া বেগম ভৈরব শহরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের মহেশপুর গ্রামের আবু কালামের স্ত্রী। তাঁর স্বামী দিনমজুর। এক ছেলে থাকেন প্রবাসে। কাঁদতে কাঁদতে রোকেয়া বলেন, ‘দুই বছর আগে চার লাখ দিছিলাম। লাখে দুই হাজার পাইতাম। পরে দিলাম সাত লাখ। মানুষের কাছ থাইক্কা আইনা দিছি আরও কয়েক লাখ। সব মিলিয়ে ৩০ লাখ হইছিল। কয়েক মাস ধরে লাভ পাই না। কইছিল ঈদের আগে ৪৮ হাজার দিব। চিন্তা কইরা রাখছি এই টেহা দিয়া ঈদ করুম...।’ এই বলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন রোকেয়া। তিনি বলেন, ‘কই করুম ঈদ। এহন দেহি হে (শাহ আলম) আমার পুঞ্জি (পুঁজি) লইয়া বাগছে। টেহা না পাইলে কইব্বরে (কবর) যাওয়া ছাড়া উপায় থাকব না। রাস্তার মধ্যে পইরা থাহুম।’

ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা জড়ো হয়ে চাঁনপুর মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের চেয়ারম্যান শাহ আলমের খোঁজ করেন। মঙ্গলবার বিকেলে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার চাঁনপুর বাজারে
ছবি: সংগৃহীত

রোকেয়ার মতো ভৈরব উপজেলার কয়েকটি গ্রামের কয়েক শ মানুষ লাভের আশায় চাঁনপুর মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে টাকা জমা দিয়েছেন। এখন সবাই হা-হুতাশ করছেন। টাকা ফিরে পেতে গ্রাহকেরা মঙ্গলবার দল বেঁধে সড়কে নেমে আসেন। বুধবার দুপুরে চাঁনপুর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, মাল্টিপারপাস কার্যালয়টিতে তালা ঝুলছে। গ্রাহকেরা এসে শুধু প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শাহ আলমের খোঁজ করছেন। কার্যালয় লাগোয়া ব্যবসায়ীরা জানান, বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অর্ধশত গ্রাহক কার্যালয় তালাবদ্ধ দেখে হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন। এ সময় অনেকে কান্নাকাটি করেন। কেউ কেউ আল্লাহর কাছে শাহ আলমের বিচার দাবি করেন।

বেলা আড়াইটার দিকে শাহ আলমের সন্ধানে মাল্টিপারপাস কার্যালয়ে এসে থমকে দাঁড়ান চাঁনপুর গ্রামের কৃষক বাবুল মিয়া (৫৫)। এসেই উপস্থিত লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করেন, ‘শাহ আলম কই?’ জানতে চাইলে বাবুল বলেন, মাল্টিপারপাসে তাঁর আমানতের পরিমাণ তিন লাখ। লাখে তিন হাজার লাভ দেওয়ার কথা বলে টাকা দেন। কিছু নিজের, আর কিছু আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে এনে এক বছর আগে টাকা জমা রাখেন তিনি। তিন মাস লাখে তিন হাজার করে পেয়েছেন। চার মাস পান আড়াই হাজার টাকা করে। দেড় হাজার করে পেয়েছেন এক মাস। চার মাস ধরে কোনো টাকাই পাচ্ছেন না। ঈদের আগে সুদে-আসলে টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শাহ আলম; কিন্তু সেই শাহ আলম এখন লাপাত্তা।

চাঁনপুর মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের কার্যালয় তালাবদ্ধ। বুধবার বেলা সোয়া ২টার দিকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার শিমুলকান্দি ইউনিয়নের চাঁনপুর বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

বেলা পৌনে তিনটার দিকে বোরকা পরিহিত দুই নারী শাহ আলমকে বকতে বকতে সড়ক পার হচ্ছিলেন। দুজনের একজন নাসিমা বেগম (৪৫)। তাঁর বাড়ি উপজেলার নবীপুর গ্রামে। নাসিমা বলেন, এই মাল্টিপারপাসে তাঁর জমা ছিল পাঁচ লাখ এবং তাঁর এক ভাইয়ের স্ত্রীর সাত লাখ টাকা ছিল। বেশি লাভের আশায় প্রবাস থেকে পাঠানোর স্বামীর টাকা স্বামীকে না জানিয়ে জমা রেখেছিলেন। এখন স্বামীকে কী জবাব দেবেন? এই চিন্তায় ঘুম আসে না।

ভুক্তভোগী লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার চাঁনপুর, রাজনগর, তুলাকান্দি, নবীপুরা ও পৌর শহরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের রামশংকপুর ও মহেশপুর এলাকায় মাল্টিপারপাসের বেশি গ্রাহক। চাঁনপুর বাজারে চাঁনপুর মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের কার্যালয় চালু করা হয় ২০১০ সালের মাঝামাঝি। চেয়ারম্যান শাহ আলমের বাড়ি চাঁনপুর মধ্যপাড়ায়। লাখে দুই হাজার টাকা লাভ দেওয়ার কথা বলে মানুষের কাছ থেকে আমানত নিতেন। বিনিময়ে দিতেন ব্যাংকের চেক। আবার চড়া সুদে মানুষকে ঋণও দিতেন। মাঠ থেকে ঋণের টাকা সংগ্রহের জন্য ছিলেন আটজন কর্মী। শাহ আলমকে লোকজন বিশ্বাস করতেন। এ জন্য অনেকে জমি বিক্রি করে লাভের আশায় তাঁর কাছে টাকা জমা রাখতেন। কেউ কেউ আবার ব্যাংকে টাকা না রেখে শাহ আলমের কাছে রাখতেন। কয়েক শ মানুষের প্রায় ছয় কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন শাহ আলম ও তাঁর সহযোগীরা।

চাঁনপুর বাজারে মাল্টিপারপাসের মাঠকর্মী রাকিব মিয়ার সঙ্গে দেখা হয়। তাঁর কাছে জানতে চাইলে রাকিব বলেন, ‘আমি কয়েক মাস চাকরি করেছি, এখন আর করি না।’ কয়েক শ মানুষ বিশেষ করে নারীরা শাহ আলমকে বিশ্বাস করে তাঁর কাছে অর্থ জমা রেখেছিলেন বলে জানান তিনি।

মুঠোফোন নম্বর বন্ধ থাকায় অভিযোগের বিষয়ে শাহ আলমের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর বসতঘরে তালা। প্রতিবেশীরা জানান, শাহ আলমের বাবা-মা বেঁচে নেই। কাউকে কিছু না জানিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পালিয়ে যাওয়ায় পর কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই।

ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা জড়ো হয়ে চাঁনপুর মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের চেয়ারম্যান শাহ আলমের খোঁজ করেন। বুধবার দুপুরে চাঁনপুর বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

অভিযোগ প্রমাণিত হলে চাঁনপুর মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের নিবন্ধন বাতিল করা হবে জানান ভৈরব উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা রুবাইয়া বেগম।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শবনম শারমিন বলেন, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত যেকোনো একজন ফৌজদারি ধারায় মামলা করতে পারেন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।