দোলনার এক কারিগরের রোগ আর কষ্টে দিনপাত

অসুস্থ শরীর নিয়ে নগেন চন্দ্র মোহন্ত তাঁর বাড়ির আঙিনায় দোলনা তৈরি করে চলেছেন। গত শনিবার দিনাজপুরের বিরামপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বাঁশের চিকন কাঠির গোলাকার ফ্রেমের ভেতরে বসে কাজ করছেন নগেন চন্দ্র মোহন্ত (৫৪)। একটি কাঠির সঙ্গে মোটা সুতা দিয়ে আরেকটি কাঠি জোড়া লাগাতে তাঁর হাত চলছে নিখুঁতভাবে। আড়াআড়ি সাজানো লাল-সবুজ রঙের কাঠির নিপুণ কারুকাজ শেষে ফ্রেমে লাগিয়ে দেন রঙিন দড়ি। তৈরি হয় শিশুদের দোলনা। নগেনের কাছ থেকে কেনা রঙিন দোলনায় শুয়ে শিশুরা হয়তো শান্তিতে ঘুমায়; কিন্তু জটিল রোগ আর আর্থিক অনটনে নির্ঘুম রাত কাটান দোলনার কারিগর নগেন চন্দ্র।

দিনাজপুরের বিরামপুর পৌর শহরের রেলস্টেশন এলাকায় নগেন চন্দ্র মোহন্তের বাড়ি। দীর্ঘ চার বছরের বেশি সময় ধরে তিনি শুক্রাশয়ের সংক্রমণ, গোদরোগ ও প্রস্রাবের জ্বালাপোড়ায় ভুগছেন। এ সংক্রমণে জননাঙ্গ কখনো ফুলে গিয়ে সেখানে প্রচণ্ড ব্যথা করে। এতে তিনি প্রায় সময় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। দোলনা তৈরি ও বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে নিজের চিকিৎসা ও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন নগেন চন্দ্র। এরই মধ্যে গ্রাম্য চিকিৎসক থেকে শুরু করে শহরের বড় চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। গত চার বছরে অনিয়মিত চিকিৎসায় তাঁর রোগ এখন জটিল রূপ নিয়েছে।

এক মাস আগেও দোলনা তৈরির কাজে যে হাত নৈপুণ্য দেখাত, শরীরের পীড়ায় সেই হাত আর আগের মতো কাজ করতে পারে না। চিকিৎসক জানিয়েছেন, খুব শিগগির অস্ত্রোপচার করতে হবে। এতে খরচ হবে লাখখানেক টাকা। চিকিৎসার টাকা কীভাবে জোগাড় হবে, তা জানেন না নগেন চন্দ্র।

দোলনা তৈরি ও বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে নিজের চিকিৎসা ও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন নগেন চন্দ্র। গত চার বছরে অনিয়মিত চিকিৎসায় তাঁর রোগ এখন জটিল রূপ নিয়েছে।

৬ এপ্রিল নগেন চন্দ্রের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির আঙিনায় তাঁর স্ত্রী দ্রৌপদী রানী দোলনার কাঠিতে নীল রং করছেন। পাশে অসুস্থ শরীর নিয়ে নগেন চন্দ্র দোলনার ফ্রেমের ভেতরে বসে দোলনার কাঠি জোড়া দিতে সুতা বাঁধছেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে এভাবে কাজ করতে প্রায় সময় আর পারেন না, কখনো শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন বলে জানালেন তাঁর স্ত্রী। প্রায় রাতে ঘুমাতে পারেন না, যন্ত্রণায় ছটফট করে কাটান।

দ্রৌপদী রানী জানান, তাঁদের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে তিন বছর আগে। আর ছোট মেয়ের বিয়ে হয়েছে মাসখানেক হলো। ছেলে একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে।

এই শরীল নিয়ে আগের মতো আর দোলনা বানবার পারো না। ডাক্তার কইছে অপারেশন করবার নাগবে। এক লাখ টাকার মতো খরচ হইবে। এত টাকা মুই কোত্তে (কোথায়) পাবু। কেউ যদি হেল্প করলো হয়, তাহলে তো অসুখ সারলো হয়।
নগেন চন্দ্র মোহন্ত

নগেন চন্দ্র জানান, তাঁর পৈতৃক ভিটা ছিল বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা সান্দিরা গ্রামে। সেখান থেকে কোনো জমি-সম্পদ পাননি তিনি। তাঁর প্রয়াত বাবা নকুল চন্দ্র মোহন্তও পেশায় ছিলেন দোলনা তৈরির কারিগর। বাবার কাছ থেকেই দোলনা তৈরির কাজ শিখেছিলেন নগেন। দোলনা তৈরি করে সেগুলো বগুড়ার সান্তাহার বাজারে বিক্রি করতেন। মাঝেমধ্যে দোলনা বিক্রি করতে বিরামপুর শহরে আসতেন। সেখানে তাঁর তৈরি করা দোলনা ভালো বিক্রি হতে থাকায় প্রায় ২০ বছর আগে বিরামপুর পৌর শহরে বাসা ভাড়া নেন। এরপর শহরের ঢাকা মোড়ে দোলনার দোকান দেন। পরবর্তী সময়ে বিরামপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় রেলওয়ের জায়গাতে টিনের ছাউনি ও বেড়া দিয়ে বাড়ি করে সেখানেই বসত গড়েন তিনি।

বাজার থেকে বাঁশ, দড়ি ও রং কিনে বাড়িতে নিয়ে দোলনা তৈরি করেন নগেন। দিন শেষে তৈরি হওয়া দোলনা পৌঁছে দেন শহরের স্থানীয় দোকানে। তাঁর কাজে এত দিন সহায়তা করে এসেছেন স্ত্রী ও ছোট মেয়ে। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ায় বাড়িতে এখন দোলনা তৈরির কাজে একমাত্র সহযোগী স্ত্রী। পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় নগেন চন্দ্র আগে যেখানে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচটি করে দোলনা তৈরি করতে পারতেন, সেখানে এখন সেই সংখ্যা কমে গেছে। স্ত্রীকে নিয়ে সারা দিনে দুটি দোলনা তৈরি করেন। আর এতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়।

নগেন ও দ্রৌপদী বলেন, আয়ের টাকায় প্রতিদিন ১৯৪ টাকার ওষুধ, ছেলের পড়ালেখা খরচ আর খাবার জোটাতে অসুস্থ শরীর নিয়ে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এ ব্যাপারে কথা হয় বিরামপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আবদুল আউয়ালের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নগেন চন্দ্র যদি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর অপারেশন করাতে চান, সে ক্ষেত্রে হাসপাতালে সমাজসেবা থেকে ওষুধ ও অপারেশন উপকরণ কিনতে সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা চলাকালে তাঁর ওষুধ কেনার জন্য উপজেলা সমাজসেবা থেকে আর্থিক সহযোগিতা করা হবে।’

নগেন চন্দ্র প্রথম আলোকে বলেন, ‘শরীলের অসুখ নিয়ে খুব কষ্টোত আছো। এই শরীল নিয়ে আগের মতো আর দোলনা বানবার পারো না। আয়রোজগারও আগের মতো হয় না। তার ওপোরোত আবার ডেইলি ১৯৪ টাকার ঔষধ কিনবার নাগে (লাগে)। অ্যালা চিন্তা করলে তো দুচোখোত আন্দার (অন্ধকার) দ্যাখো। ডাক্তার কইছে অপারেশন করবার নাগবে। এক লাখ টাকার মতো খরচ হইবে। এত টাকা মুই কোত্তে (কোথায়) পাবু। কেউ যদি হেল্প করলো হয়, তাহলে তো অসুখ সারলো হয়।’