‘বিদেশে আমার আর ভালো লাগছে না’
‘এখানে কেউ বাংলায় কথা বলে না। তাই আমি আবৃত্তিও করতে পারি না। এখানে আমার কোনো ভালো বন্ধু নেই। কারও সঙ্গে মন খুলে কথাও বলতে পারি না। বিদেশে আমার আর ভালো লাগছে না। মাঝেমধ্যেই দেশে চলে যেতে ইচ্ছা করে। দেশের মাটির সুঘ্রাণ, ঈদ, নববর্ষ ও নবান্নে একসঙ্গে আনন্দের কথা খুব মনে পড়ে। তোর মনে আছে, নববর্ষের দিন আমরা সবাই নতুন পোশাকে নতুন সাজে বৈশাখী মেলায় যেতাম। আর কত কী কিনতাম?’ এই চিঠি লিখে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে তাজমিলা অরিন। সে রাজবাড়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ‘ক’ শাখার শিক্ষার্থী।
চিঠিতে প্রতীকী অর্থে প্রবাসী এক শিশুর বাংলাদেশের প্রতি তীব্র আকর্ষণ, বন্ধুর সঙ্গে কাটানো মুহূর্তের স্মৃতিচারণা ও দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা ফুটিয়ে তুলেছে তাজমিলা। সেই চিঠিতে তাজমিলা অরিন আরও লিখেছে, ‘এবার বল দেশের খবর কী? টিভির সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম, আমাদের দেশে ডেঙ্গুর উপদ্রব বেড়েছে। তুই কিন্তু সাবধানে থাকবি। আর তোর ছোট বোন নৈপুণ্যকেও সাবধানে রাখবি। দিনে অথবা রাতে ঘুমানোর পূর্বে অবশ্যই মশারি টানিয়ে ঘুমাবি। তোর বাগানের টবগুলোতে কিন্তু পানি জমতে দিবি না। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখিস। নৈপুণ্য যেন পুকুরের আশপাশ দিয়ে না খেলে। কারণ, এখন বাংলাদেশে বর্ষাকাল। পুকুর-নদী পানিতে ভরে যাচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে পানিতে পড়ে যেতে পারে।’
রাজবাড়ীতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০ হাজার শিক্ষার্থীর চিঠি নিয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয়েছে চিঠি উৎসব ও বইমেলা। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশে ও লেখালেখিতে আগ্রহী করে তুলতে লেখক-পাঠক কেন্দ্রের উদ্যোগে জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে এ উৎসব হয়। এতে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা চিঠি লেখা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের লেখা বিভিন্ন চিঠি পড়ে শোনানো হয়। স্মৃতিচারণা করেন অতিথিরা। নিজের শৈশবে ফিরে যান অনেকে। মিলনায়তন ভর্তি দর্শক গভীর মনোযোগ দিয়ে তা উপভোগ করেন।
অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক তুষার আবদুল্লাহ। উৎসব উপলক্ষে আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন চিঠি উৎসব কমিটির আহ্বায়ক রনজিৎ কুমার সরকার। এতে বক্তব্য দেন লেখক-পাঠক কেন্দ্রের সভাপতি কবি নেহাল আহমেদ, রাজা সূর্য কুমারের নাতি সুভাগত রায় গুহ, জেলা মহিলা পরিষদের সাবেক সভাপতি লাইলী নাহার, রাজবাড়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল হামিদ প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কবি ফারহানা মিনি। অনুষ্ঠানে কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা অংশগ্রহণ করেন।
রাজবাড়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল হামিদ বলেন, ‘চিঠি লেখাও সাহিত্যের একটি অংশ। অনেক রকম চিঠি আছে। বরেণ্য ব্যক্তিদের চিঠি নিয়ে গবেষণা হয়। বই বের হয়। বিশ্লেষণধর্মী লেখা বের হয়। জেলা পর্যায়ে এ ধরনের আয়োজন একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। এতে আমাদের মনে পুরোনো স্মৃতি ভেসে উঠেছে। কারণ, আমাদের সময়ে চিঠি লেখেনি, এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। অথচ এখনকার ছেলেমেয়ে এসব ভুলেই গেছে।’
চিঠি উৎসব উপলক্ষে জেলার পাঁচটি উপজেলার বিভিন্ন মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চিঠি সংগ্রহ করা হয়। ১০ হাজার চিঠির মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে অংকুর কলেজিয়েট উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোহাম্মদ শান্ত মোল্লা। তাকে পুরস্কার হিসেবে ১০ হাজার টাকা ও বই উপহার দেওয়া হয়। তৃতীয় স্থান অর্জনকারী ১০ জনকে বই উপহার দেওয়া হয়েছে।
লেখক-পাঠক কেন্দ্রের সভাপতি কবি নেহাল আহমেদ বলেন, চিঠির কথা প্রায় সবাই ভুলে গেছে। কিন্তু চিঠি লিখতে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। লেখালেখির প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। নতুন নতুন ভাবনা মাথায় আসে। আর সাহিত্য ও সৃষ্টিশীল শিল্পকর্ম তৈরির কারিগর তৈরি হয়। শিশু-কিশোরদের সৃষ্টিশীল মানসিকতা তৈরি করতে এই আয়োজন করা হয়। এতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে।
অংকুর কলেজিয়েট উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠান থেকে অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী চিঠি লিখে সেরা হয়েছে। এটি খুব গর্বের বিষয়। কারণ, এখন আমরা চিঠি লেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। তবে চিঠি লিখলে একেকজনের একেক রকম প্রতিভা বিকশিত হয়।’