‘বন্যাতে একবারে সব লইয়া গেছেগা’

সিলেটে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে পারছে না কয়েকটি পরিবার। গতকাল বিকেলে সিলেটের কান্দিগাও ইউনিয়নের ঘোপাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রেছবি: প্রথম আলো

সুরমা নদীর কূলঘেঁষা ঘোপাল গ্রামে ছিল লিপি বেগমের (৩৫) বসতভিটা। গত মার্চ মাসের শেষ দিকে ভারী শিলাবৃষ্টিতে তাঁর চৌচালা ঘরটির টিনের চাল ফুটো হয়। সেই থেকেই তাঁর দুর্দিনের শুরু যেন! ঘরটির চালে পলিথিন মুড়িয়ে কোনোরকম চলছিলেন এত দিন। এরপর কালবৈশাখীর আঘাতে খুঁটি নড়বড়ে হয়ে ঘরটি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। শেষে ১৭ জুন বন্যার পানি এসে ঢোকে এতে। নড়বড়ে ঘরটি এবার হেলে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় লিপি বেগম ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। আপাতত তাঁর দেখা মিলবে সিলেট সদরের কান্দিগাও ইউনিয়নের ঘোপাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে।

গতকাল শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে আশ্রয়কেন্দ্রটিতে গেলে প্রথম আলোর প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় লিপি বেগমের। তিনি বলেন, 'শিল পইড়া (শিলাবৃষ্টিতে) আমার ঘরটাতে টিনের চাল ঝাঁঝরা অইয়া গেছিল। তুফানেও একবারে ঘরটারে শেষ করে লাইছে। এইল্লাইগি (এর জন্য) আমার অরির (শাশুড়ির) ঘরে থাকছিলাম। এখন বন্যা অইয়া ঘরটার আর কিছুই নাই। শিল পইড়া ঘরের চাল পুডা অইছলো, বন্যাতে একেবারে সব নিয়া গেছেগা। সব শেষ।’

আশ্রয়কেন্দ্রের কয়েকজন অস্থায়ী বাসিন্দা লিপির কথায় সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘বন্যাত ই ব্যাঠিরই (এই নারীর) বেশি খতি (ক্ষতি) অইছে। ব্যাঠির ঘরটাত ঠিকছে না।’ তাঁরা বলেন, লিপির বসতভিটায় কোমরসমান পানি উঠেছে।

পানি কমলে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে কোথায় উঠবেন, তা ভেবেই যেন লিপির চোখের পানি ফুরাচ্ছে না। দুশ্চিন্তা আর হতাশায় টানা চার দিন বিলাপ করে কেঁদেছেন তিনি। দিনমজুর স্বামীর সংসারে নতুন করে ঘর তোলার সামর্থ্য নেই তাঁর।

ঘোপালের এই আশ্রয়কেন্দ্র সিলেট সিটি করপোরেশনের টুকের বাজারসংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। চার দিন আগে এর দোতলায় দুটি কক্ষে কান্দিরগাও ও ঘোপাল গ্রামের ১৮টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। এর মধ্যে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার সিলেটের আকাশে ঝলমলে রোদের দেখা মেলে। এতে নদ-নদীর পানি কমায় আটটি পরিবার নিজেদের বসতভিটায় গিয়ে ওঠে। কিন্তু বাকি ১০ পরিবারের সদস্যদের সে সুযোগ হয়নি। তাঁদের সবার বসতভিটা সুরমা নদীর কাছাকাছি এলাকায়। নদীতে পানি একটু বাড়লেই তাঁদের বসতভিটা ও খেতখামার পানিতে ভেসে যায়।

রুবেনা আক্তার নামের ৩৫ বছর বয়সী এক নারী বলেন, তিনিসহ ওই ১০ পরিবারের সবার বসতভিটায় হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি। বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় কোথাও গলা আবার কোথাও কোমরসমান পানি আছে। তাই পরিবারগুলো চরম দুশ্চিন্তায় আছে। যদি আবারও পানি বাড়ে, তাহলে খাবার থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ে জটিলতায় পড়বেন তাঁরা।

উঠান পর্যন্ত পানি কমলেও তাঁদের শঙ্কা শিগগিরই কাটবে জানিয়ে রুবেনা বলেন, ‘ঘরের পানি শুকিয়ে গেলেও ভয় লাগে। কারণ, বাড়ির পাশে পানি তখনো থেকে যাবে। আমার চারটি শিশুসন্তান। পানিতে পড়ে যেতে পারে।’

এমন আরও অনেক শঙ্কা মাথায় নিয়ে পরিবারগুলোর সদস্যরা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি যাচ্ছেন না। পানি একেবারে না কমলে বাড়িতে ফিরবেন না তাঁরা।