সময়ের মুখ

মিনিটের মধ্যে ট্রেনে আটকে পড়া মানুষকে মরতে দেখেছি

ভৈরব রেলস্টেশন লাগোয়া পঞ্চবটী পুকুরপাড় এলাকার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম (৪৮)। ট্রেনের শব্দ কানে নিয়ে ঘুমাতে যান, আবার সেই শব্দে ঘুম ভাঙে তাঁর। গত ২৩ অক্টোবর ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনার সময় পাশেই গরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছিলেন তিনি। ওই ঘটনায় অন্তত ১৮ জনের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনাটি দেখেই ছুটে যান উদ্ধারকাজে। আহত মানুষকে উদ্ধার করে যাঁরা হাসপাতালে পাঠিয়েছেন, তাঁদের একজন তিনি। নুরুল ইসলামের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুমন মোল্লা

নুরুল ইসলাম
প্রশ্ন:

প্রথমে কী দেখলেন?

নুরুল ইসলাম: দেখলাম এগার (এগারসিন্দুর) বের হচ্ছে। মালগাড়ি ঢুকছে। কী ঘটতে যাচ্ছে, তখনো বুঝতে পারিনি। হঠাৎ কানফাটা আওয়াজ। ধুলা আর ধুলা। চেঁচামেচি।

প্রশ্ন:

তখন কী করলেন?

নুরুল ইসলাম: কী করব, বুঝতেছি না। চিৎকার দিয়া উঠলাম। কে কই আছ, তাড়াতাড়ি আসো। মরে গেছে, মরে গেছে বলতে লাগলাম।

প্রশ্ন:

উদ্ধারে অংশ নিলেন?

নুরুল ইসলাম: গরুটা একজনকে ধরিয়ে দিয়ে উদ্ধারে নামলাম। মনে হলো, প্রাণ আছে এমন লোকজনকে আগে উদ্ধার করি।

প্রশ্ন:

উদ্ধারকাজ করতে গিয়ে কোনো সমস্যায় পড়েছিলেন?

নুরুল ইসলাম: কয়েক মিনিটের মধ্যে হাজারো মানুষ হাজির। সবার হাতে মোবাইল। সবাই ভিডিও-লাইভ নিয়া ব্যস্ত। এসব লোকের জন্য আহতদের বের করে হাসপাতালে পাঠাতে কষ্ট হয়েছে।

প্রশ্ন:

ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কখন এল?

নুরুল ইসলাম: কিছুক্ষণ পরই এসেছে। ফায়ার সার্ভিস দল একবার এসে আবার যন্ত্রপাতি আনতে গিয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী লোকজনকে সরাতে ব্যস্ত ছিল।

প্রশ্ন:

উদ্ধারকাজের সময় কোন বিষয়টি মনে দাগ কেটেছে?

নুরুল ইসলাম: একজন যাত্রীর পা আটকে ছিল। বের করে আনতে পারছিলেন না। আমি গিয়ে টান দিলাম। দেখলাম বডিটা (শরীর) এসেছে, পা ট্রেনের ভেতর রয়ে গেছে।

প্রশ্ন:

উদ্ধারের নামে কিছু মানুষ তো চুরিতে ব্যস্ত ছিল?

নুরুল ইসলাম: এটা লজ্জার। মানুষের বিবেক মরে গেছে। আমি দেখেছি একজন মহিলা হাত বাড়িয়ে সাহায্যের জন্য ডাকছেন। একজন গেলেন, সাহায্য করলেন না। গলা থেকে চেইনটা নিয়ে পালাতে গেলেন। আমি ধরলাম, জোরে একটা চড় দিলাম।

প্রশ্ন:

আর কিছু?

নুরুল ইসলাম: একজন যাত্রী চাপা পড়েছেন। এই অবস্থায় বাঁচাও বাঁচাও বলছেন। চোখের সামনে মিনিটের মধ্যে ট্রেনে আটকে পড়া মানুষকে মরতে দেখেছি। তখন মনে হয়েছে, আল্লাহ যদি আমাকে শক্তি দিতেন, আর আমি একাই গাড়িটা (বগি) উল্টে ফেলতে পারতাম!

প্রশ্ন:

আপনার মতো আর কেউ কি উদ্ধারকাজে ছিল?

নুরুল ইসলাম: অনেকেই যোগ দিয়েছেন।

প্রশ্ন:

আপনি কী করেন?

নুরুল ইসলাম: গরুর খামার আছে। গরু পালন করেই সংসার চলে।

প্রশ্ন:

পরিবারে কে কে আছে?

নুরুল ইসলাম: স্ত্রী ও দুই সন্তান।

প্রশ্ন:

আগে কখনো রেল দুর্ঘটনা দেখেছেন?

নুরুল ইসলাম: রেললাইনের পাশে থাকি। ট্রেন লাইনচ্যুত হতে দেখেছি। তবে মানুষ মরতে দেখিনি।

প্রশ্ন:

কী মনে করে উদ্ধারকাজে গেলেন?

নুরুল ইসলাম: দুর্ঘটনা দেখলে মানুষকে উদ্ধার না করে কি পারা যায়।