নানা সংকটে জর্জরিত সেবা

১০ বছরের বেশি সময় ধরে শূন্য পদগুলোয় জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। রয়েছে শয্যাসংকটও।

শয্যাসংকট থাকায় বারান্দা ও মেঝেতে সেবা নিচ্ছেন রোগীরা। সম্প্রতি কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে
ছবি: প্রথম আলো

চিকিৎসক ও কর্মচারী–সংকটে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তার ওপর ভবনের সংস্কারকাজ চলায় রয়েছে শয্যাসংকটও।

সার্জারি, অর্থোপেডিক, কার্ডিওলজি, চক্ষুসহ বিশেষজ্ঞ ১০ জন চিকিৎসকের মঞ্জুরীকৃত পদ থাকলেও ১০ বছরের বেশি সময় ধরে পদগুলোয় জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

হাসপাতালের এক্স-রে যন্ত্রটি ছয় মাস ধরে কক্ষবন্দী। আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্রটিও অকেজো। তাই সেবা নিতে আসা রোগীদের বাইরে থেকে বেশি টাকা খরচ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হচ্ছে। এসব কারণে এখানে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৬ সালে কালকিনি উপজেলার ঝাউতলা ও পাঙ্গাশিয়া মৌজায় ৬ একর ৯৬ শতাংশ জমিতে ৩১ শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি যাত্রা শুরু করে। ২০১০ সালে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়।

এখানে অনুমোদিত চিকিৎসকের ২২টি পদ থাকলেও ৯টিই শূন্য। সিনিয়র স্টাফ নার্সের ৫টি পদও শূন্য। এ ছাড়া স্বাস্থ্য সহকারী, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, অ্যাম্বুলেন্সচালকসহ আরও ৩৬টি পদ শূন্য। এদিকে হাসপাতালে ১২ চিকিৎসক কর্মরত থাকলেও দেড় বছরের বেশি সময় ধরে অনুপস্থিত রয়েছেন ৩ চিকিৎসক। আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ইশরাত জাহানের বাড়ি রাজৈর উপজেলায়। মাসে তিনি দু–তিন দিন আসেন তাঁর কর্মস্থল কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।

জানতে চাইলে আরএমও ইশরাত জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কর্মস্থলে ডরমিটরিতে থাকার পরিবেশ নেই। তাই সেখানে থাকা হয় না। তা ছাড়া আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া আমার কমপ্লেক্সে যাওয়া হয় না।’

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির পাশ ঘেঁষে ছোট–বড় অন্তত ১০টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক থাকায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভেতরে দালালদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে দালাল থাকায় রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

গত ১৫ মে সকালে কালকিনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, পুরোনো দোতলা ভবনের সংস্কারকাজ চলমান থাকায় পাশের অন্য একটি দোতলা ভবনে চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম। নিচতলায় বহির্বিভাগ, অফিসকক্ষ ও জরুরি বিভাগ।

স্টোররুমে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় দ্বিতীয় তলার খোলা স্থানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে কার্টনভর্তি ওষুধসহ অসংখ্য চিকিৎসাসামগ্রী রাখা হয়েছে। পরীক্ষাগারটির ভেতরের অংশ ভাঙাচোরা চেয়ার–টেবিল, কিছু খোলা কার্টনসহ চিকিৎসা বর্জ্যে ভরা।

এই হাসপাতালে ভর্তি হতে এসে রোগীরা পড়েন গোলকধাঁধায়। কারণ, রোগীদের ওয়ার্ডে যেতে হলে দোতলার বারান্দা ঘুরে সংস্কারকাজ চলতে থাকা ভবনটির ভেতর দিয়ে পেছনের একটি পুরোনো ভবনে যেতে হয়। ৫০ শয্যার বিপরীতে এই পুরোনো ভবনে রয়েছে ৩১ শয্যা। শিশু, পুরুষ ও নারী রোগীদের পৃথক কোনো ওয়ার্ড নেই। তাঁদের একই ওয়ার্ডে পাশাপাশি রাখা হয়েছে। বারান্দা ও মেঝেতে আটটি শয্যা রাখা হয়েছে।

উপজেলার পূর্ব এনায়েতনগর এলাকা থেকে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন শাহীন হাওলাদার (২৮)। শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে জরুরি বিভাগে আনার পরই চিকিৎসক ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেন। কোনো ট্রলি না পাওয়ায় স্ত্রীকে কোলে নিয়েই দোতলায় উঠি। কার্টনভর্তি ওষুধ ছাড়া দোতলায় আর কাউকেই দেখি না। কোনো ওয়ার্ডে যাব, না বুঝে আবার নিচে নামি। এদিকে আমার স্ত্রী ছটফট করছে। এমন করে স্ত্রীকে দুবার কোলে নিয়ে ওঠানামার পর তৃতীয়বার একজন নার্স আমার ছোটাছুটি দেখে সাহায্য করেন। পরে ওই নার্স অনেকটা পথ ঘুরিয়ে লেবার ওয়ার্ডে নিয়ে যান। এই হচ্ছে আমাদের হাসপাতালের সেবা। কিছু বলার ভাষা নেই আমার।’

হাসপাতালের মেঝেতে তিন দিন ধরে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কর্মী আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, ‘জ্বর নিয়ে ভর্তি। রোগীর চাপ বেশি থাকায় ভেতরে জায়গা পাইনি। মেঝেতে একটা সিট পেয়েছি। সেখানে মশা–মাছির যন্ত্রণায় টেকা যায় না।’

হাসপাতালের সিনিয়র নার্স নিলুফা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল ভবনের সংস্কারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত রোগীদের সমস্যা থাকবেই। জায়গা কম থাকায় আমরা শিশু, পুরুষ ও নারীদের একসঙ্গে রাখছি। রোগীর চাপ সব সময় থাকায় আমরাও সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছি।’

কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস কে এম শিবলী রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সব পদেই সংকট আছে। একজন চিকিৎসক কোথায় আছেন, সে খবর আমরা পাচ্ছি না। তাই পলাতক ধরে নিয়েছি। আরেক চিকিৎসক অনুমতিহীন ছুটি নিয়ে বাইরে ছিলেন, পরে আর যোগদান করেননি।

আরেকজন অ্যানেসথেসিয়া কনসালট্যান্ট নিয়োগ হওয়ার পর থেকে এখন অবধি যোগদান করেননি। আর আরএমও তিন মাস হলো অন্তঃসত্ত্বা। তাঁর ব্যাপারটা আমরা বিবেচনাধীন রেখেছি।’

স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘পুরোনো ভবনের সংস্কারকাজ জুন মাসে কাজ শেষ হলে আমরা ওখানে সংযুক্ত হব। তখন শয্যাসংকট থাকবে না। তা ছাড়া ৩১ শয্যার হাসপাতাল ৫০ শয্যার করা হলেও জনবল এখন পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তাই সেবা নিয়ে কিছুটা অভিযোগ থাকবে। এরপরও আমরা চেষ্টা করছি ভালো সেবা দেওয়ার জন্য।’