ইউটিউবে ভিডিও দেখে, প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি চাষ করছেন কালো পোকা
ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে ডিপ্লোমা করে চাকরির খোঁজে বিভিন্ন অফিস ঘুরেছেন মো. শিমুল (২৯)। কিন্তু চাকরি মেলেনি। বাধ্য হয়ে বাড়িতে ফিরে হাঁসের খামার করেন। এখানেও লোকসান। তবে ভেঙে পড়েননি শিমুল। মাত্র ১৪ হাজার টাকা পুঁজিতে শুরু করেন কালো পোকার (ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই) চাষ। এতে ঘুরে যায় ভাগ্যের চাকা। মাত্র পাঁচ বছরে তিনি স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন।
তরুণ এই উদ্যোক্তার বাড়ি পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার পারসিধাই গ্রামে। বর্তমানে তিনি পাঁচটি পোকার খামার গড়ে তুলেছেন। এই পোকা মূলত হাঁস, মুরগি ও মাছের খাবার। পাশাপাশি তিনি হাঁস, মুরগি ও মাছের খামার করেছেন। মাসে আয় করছেন প্রায় তিন লাখ টাকা।
পোকা চাষ করায় স্থানীয় লোকজন আমাকে পাগল ভাবত। কিন্তু এই পোকাই আমার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। বর্তমানে আমি ভারত, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানে পোকা রপ্তানি করছি।
শুরুটা ২০১৮ সালে। চাকরির খোঁজে ঢাকা ঘুরে বাড়িতে ফেরেন শিমুল। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। উদ্যোক্তা হওয়ার ঝোঁক থেকে প্রথমে একটি হাঁসের খামার করেন। প্রায় সাড়ে তিন হাজার হাঁসের খামারটিতে দুই বছরে ২৭ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয় তাঁকে। ঋণের জালে আটকা পড়লেও দমে যাননি শিমুল। ইউটিউবে ভিডিও দেখে কালো পোকা চাষে আগ্রহ হয়। এরপর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। বাজারব্যবস্থা নিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার পর ২০২০ সালে মাত্র ১৪ হাজার টাকা পুঁজিতে কালো পোকার চাষ শুরু করেন তিনি।
মো. শিমুল জানান, কালো পোকা মূলত হাঁস, মুরগি ও মাছের খাবার। প্রচলিত ফিডের তুলনায় এর পুষ্টিমান বেশি। উৎপাদন খরচও কম। তা ছাড়া কালো পোকা ও মাদার পোকা চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। বর্তমানে তিনি কালো পোকা ও মাদার পোকা রপ্তানি করছেন। নিজ গ্রাম ছাড়াও ঈশ্বরদী উপজেলার রাজাপুর ও দাশুড়িয়ায় তাঁর পাঁচটি পোকার খামার আছে। পাশাপাশি হাঁস, মুরগি ও মাছের খামার করেছেন। নিজের খামারের কালো পোকা দিয়েই এসব খামারের খাদ্যের চাহিদা মিটছে।
গত মঙ্গলবার আটঘরিয়ার পারসিধাই গ্রামে শিমুলের পোকার খামারে গিয়ে দেখা যায়, একচালা টিনের ঘর। চারদিকে খোলা। জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে চারপাশ। ঘরটির মেঝেতে ইটের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট চৌবাচ্চা। এর মধ্যেই চাষ হচ্ছে পোকা। পোকাগুলো দেখতে মাছির মতো। আকারে মাছির তুলনায় কিছুটা লম্বা। এদের খাদ্য হিসেবে দেওয়া হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা ও হোটেলের খাবারের উচ্ছিষ্ট।
খামারে কাজ করা কর্মীরা জানান, কালো পোকা কিছুটা শক্ত খোলসযুক্ত। এই পোকা উৎপাদনে প্রথমে মাদার পোকাগুলো একটি জালের মধ্যে আলো-বাতাসে রাখা হয়। পোকাগুলো কাঠের গুঁড়ার মধ্যে ডিম দেয়। ডিম ফোটার ১৪ থেকে ১৫ দিন পর এগুলো পোকায় পরিণত হয়। পরে সেগুলো তুলে বিক্রি করা হয়।
শিমুলের ভাষ্যমতে, কালো পোকার খামার করে তিনি গত পাঁচ বছরে ২৭ লাখ টাকার ঋণ শোধ করার পাশাপাশি নতুন খামার করতে ব্যয় করেছেন আরও ৩০ লাখ টাকা। বর্তমানে প্রতিদিন খামারগুলো থেকে প্রায় ৩০০ কেজি কালো পোকা উৎপাদন হচ্ছে। প্রতি কেজি পোকা ৮০ টাকা দরে বিক্রি করেন। এক কেজি পোকা উৎপাদনে খরচ হয় মাত্র ১০ টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে খামারগুলো থেকে মাসে তাঁর আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা আয় থাকছে।
মো. শিমুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পোকা চাষ করায় স্থানীয় লোকজন আমাকে পাগল ভাবত। কিন্তু এই পোকাই আমার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। বর্তমানে আমি ভারত, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানে মাদার পোকা রপ্তানি করছি। পুষ্টিগুণ বেশি থাকায় দিন দিন কালো পোকার চাহিদা বাড়ছে।’
জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, দেশে হাঁস-মুরগির খামার আছে প্রায় ৬০ হাজার। চাহিদা থাকায় প্রতিনিয়ত তা বাড়ছে। এ জন্য কালো পোকার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে দেশের ২৫ জেলায় ২৮০ জনের বেশি উদ্যোক্তা বাণিজ্যিকভাবে কালো পোকা চাষ করছেন। মাসে প্রায় ৭০ টন কালো পোকা উৎপাদন হচ্ছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দীপক কুমার পাল বলেন, প্রচলিত বাজারে মাছ ও পোলট্রির খাবারের প্যাকেটে সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ প্রোটিন থাকে। কিন্তু কালো পোকায় প্রোটিনের পরিমাণ ৪৩ থেকে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত। এ কারণে দেশে ক্রমেই মাছ ও পোলট্রির খাবার হিসেবে কালো পোকা জনপ্রিয় হচ্ছে। কালো পোকা চাষে তাঁরা নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিচ্ছেন।