ঠাকুরগাঁওয়ে আগাম সবজি আবাদ, নীল আকাশের নিচে যেন সবুজ গালিচা 

বিস্তীর্ণ খেতে বাহারি শীতের সবজি চাষ করেছেন কৃষকেরা। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বড়দেশ্বরী এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

গ্রামের মাঠে মাঠে এখন সবুজের বিস্তার। বাতাসে হিম হিম অনুভূতি। ঝলমলে রোদে সবুজ খেতের ওপর নীল আকাশে ভাসমান মেঘ, রোদ-ছায়ার খেলায় যেন এক কাব্যিক আবহ তৈরি করেছে। চারদিকে এমন পরিবেশ জানান দিচ্ছে, প্রকৃতিতে এসেছে হেমন্ত। সামনে শীতকাল। আর শীত মানেই সবজির মৌসুম।

শীত এলেই বাজারে রকমারি সবজির দাপট বাড়ে। তবে ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষকেরা শীতের আগেই সবজি আবাদ শুরু করেন। হেমন্তের সময়ে খেতজুড়ে তাই দেখা যায় সবুজের উচ্ছ্বাস, যেন নীল আকাশের নিচে বিছানো সবুজ গালিচা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয় জানিয়েছে, এ বছর জেলায় ৭ হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ১৩ হাজার ৬৪০ মেট্রিক টন। অনেক কৃষকই এবার আগাম সবজি আবাদ করেছেন, ফলে বাজার এখন বেশ সরগরম।

বিক্রেতারা জানান, সরবরাহ বাড়ায় সবজির দাম প্রতিদিনই কিছুটা করে কমছে। আগাম চাষ করা কৃষকেরা ইতিমধ্যে ভালো লাভ করেছেন। সম্প্রতি সদর উপজেলার বড়দেশ্বরী, পাটিয়াডাঙ্গী, গড়েয়া, নারগুন, রানীশংকৈলের রাউতনগর, নেকমরদসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মাঠের পর মাঠজুড়ে সবুজ সবজির সমারোহ। কৃষক-শ্রমিকেরা খেত থেকে সবজি তুলে সড়কের ধারে স্তূপ করছেন। সেখানে স্থানীয় ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পাইকারেরা নগদ টাকায় সবজি কিনছেন। পরে ট্রাকে করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন দেশের বিভিন্ন জেলায়।

সদর উপজেলার চণ্ডীপুর গ্রামের শরিফুল ইসলাম একসময় ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ এমন পরিস্থিতির মধ্যে ছিলেন। পাঁচ বছর আগে বাড়ির পাশের জমিতে সবজি চাষ শুরু করেন। পরে কীটনাশক ছাড়া আধুনিক পদ্ধতিতে চাষে ঝুঁকেন। আড়াই বিঘা জমিতে এখন ফুলকপি, বাঁধাকপি, করলা, বেগুন, কাঁচা মরিচসহ নানা সবজি চাষ করে ভালো আয় করছেন তিনি। তাঁর উৎপাদিত সবজি ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। আশপাশের তিন শতাধিক কৃষক ফেরোমন ফাঁদ, হলুদ টেপ, জৈব বালাইনাশক ও জৈব সারের মাধ্যমে সবজি চাষ করছেন।

সদরের দক্ষিণ বঠিনা এখন পরিচিত ‘নিরাপদ সবজি গ্রাম’ হিসেবে। বেসরকারি সংস্থা ইএসডিওর পরামর্শে গ্রামের ৫০ জন চাষি পতিত জমিতে পরিবেশবান্ধব সবজি আবাদ করেন। সংস্থাটি বাজারজাতকরণের জন্য স্থাপন করেছে সবজি বিপণনকেন্দ্র। পাইকারেরা এখান থেকে সবজি কিনে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও পাঠাচ্ছেন।

রানীশংকৈল থেকে কাঁঠালডাঙ্গী যাওয়ার পথে রাউতনগর গ্রামের পাশে সড়কে ফুলকপি, বাঁধাকপি ও বেগুনের স্তূপ চোখে পড়ে। শ্রমিকেরা ব্যস্ত ট্রাকে সবজি তুলতে। নির্দেশনা দিচ্ছেন ঢাকার শাঁখারীবাজারের রহিমউদ্দিন (৫৪)।

ওই গ্রামের কৃষক হোসেন আলী চার বিঘা জমিতে প্রায় দুই লাখ টাকা ব্যয়ে ফুলকপি আবাদ করে খেত থেকেই তিন লাখ টাকার বেশি পেয়েছেন। সেই আয় দিয়ে বাড়িতে দুটি ঘর নির্মাণ করেছেন তিনি।

সদরের খড়িবাড়ি উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে দুটি ট্রাক থামানো। শ্রমিকেরা সবজি বোঝাই করছেন। দেখভাল করছেন রংপুরের মিঠাপুকুরের মো. রোকসাদ আলী। তাঁর ভাষ্য, প্রতিদিন দুই-তিন ট্রাক সবজি ঢাকার কারওয়ান বাজারে পাঠান। বড়দেশ্বরী, খড়িবাড়ি, পাটিয়াডাঙ্গী, রাজাগাঁও এলাকা থেকে প্রতিদিনই ২০-২৫টি ট্রাক সবজি দেশের বিভিন্ন জায়গায় যায়।

বড়দেশ্বরীর আবদুর রশিদ ১৪ বিঘায় করলা-লাউ অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ করছেন। অর্গানিক সবজির চাহিদা বেশি হওয়ায় লাভও বেশি হয়। তাঁর সবজি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাশাপাশি এক এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।

হরিপুর উপজেলার টেংরিয়া গ্রামের কৃষক সমিরুল ইসলাম বলেন, তাঁদের গ্রামটি ফুলকপির জন্য সুপরিচিত। পাশের কয়েকটি গ্রামেও ব্যাপক ফুলকপি চাষ হয়। তিনি চার বিঘায় দুই লাখ টাকা ব্যয়ে ফুলকপি চাষ করে বিক্রি করেছেন চার লাখ টাকার বেশি। বালিয়াডাঙ্গীর ভানোর এলাকার কৃষক সামসুদ্দিন তিন বিঘায় বেগুন চাষ করেছেন, প্রতি মণ ১ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিনি বেশ খুশি।

এ বছর জেলায় ৭ হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ১৩ হাজার ৬৪০ মেট্রিক টন। অনেক কৃষকই এবার আগাম সবজি আবাদ করেছেন, ফলে বাজার এখন বেশ সরগরম।

সদরের চামেশ্বরী গ্রামের মেহেদী আহসানউল্লাহ চৌধুরী বলেন, নীল আকাশের নিচে সবুজ খেত দেখলে মন ভরে যায়। প্রতিবছরই কৃষকেরা অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষে ঝুঁকছেন এবং ভালো লাভও পাচ্ছেন। সবজি এই অঞ্চলের কৃষকের জীবন পাল্টে দিয়েছে।

সবজি চাষে শুধু কৃষকেরা নয়, এলাকার অসহায় নারীরাও কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন। বড়দেশ্বরীর মাহমুদা বেগম বলেন, আগে নিয়মিত কাজ ছিল না। এখন সারা বছর সবজিখেতে কাজ পাওয়া যায়। এতে তাঁর সংসার ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ স্বাচ্ছন্দ্যে চলে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মাজেদুল ইসলাম বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ঠাকুরগাঁওয়ে সবজির ভালো ফলন হয়। স্থানীয় প্রয়োজন মিটিয়ে এখানকার সবজি দেশের বিভিন্ন স্থানে ও বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। শীতকালীন সবজি থেকে কৃষকেরা অতিরিক্ত আয় করছেন। চাষিদের পাশে তাঁরা সব সময় আছেন।