সন্তানদের ‘সম্পদ’ হিসেবে গড়েছেন মাহমুদা

মাহমুদা বেগম
ছবি: প্রথম আলো

নিজে বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি মাহমুদা বেগম (৭০)। তাই মনে একটা জেদ ছিল। সন্তানদের লেখাপড়া করাবেন, মানুষের মতো মানুষ করবেন। তাঁরা নিজেরা যেন স্বাবলম্বী হয়। তাই ধনসম্পত্তি গড়ার পেছনে না ছুটে সন্তানদের সম্পদ হিসেবে গড়ার সংকল্প করেন মাহমুদা। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছেন। এখন তাঁর সাত সন্তানদের কেউ কলেজে, কেউ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আবার কেউ করছেন সরকারি চাকরি।

মাহমুদা বেগমের বাড়ি সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের ভাদেরটেক গ্রামে। তাঁর পরিশ্রমকে স্বীকৃতি দিতে উপজেলা প্রশাসন ২০২২ সালে ‘সফল জননী’ হিসেবে তাঁকে জয়িতা পুরস্কার দিয়েছে। এখন সংসারে অভাব নেই। তারপরও মাহমুদা বসে নেই। বাড়ির সব কাজই করেন। মাঝেমধ্যে সময় দেন পল্লি চিকিৎসক স্বামী সিরাজুল ইসলামের ফার্মেসিতে।

গতকাল শনিবার দুপুরে বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, উঠানে কড়া রোদে ধান শুকানোর কাজ করছেন মাহমুদা। কথায় কথায় জানালেন, তাঁর বাবার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। ৫০ বছর আগে হাওর এলাকায় বউ হয়ে আসেন। রাস্তাঘাট না থাকায় তখন এই এলাকার সঙ্গে সদরের মানুষের তেমন যোগাযোগ ছিল না। ফলে এই এলাকার মানুষ সন্তানদের পড়াশোনা করাতেন না। তাঁর শ্বশুরের জমি-জিরাত ছিল। কিন্তু প্রায়ই পাহাড়ি ঢল কিংবা অকাল বন্যায় ফসলের ক্ষতি হতো। তারপরও যা ধান পাওয়া যেত সেগুলো বাড়িতে আনা, শুকানো, গোলায় তোলা—সবই করতে হতো তাঁকে। সংসারে টানাপোড়েন থাকলেও তিনি সন্তানদের পড়াশোনা করাবেন বলে স্থির ছিলেন।

মাহমুদা বলেন, তাঁর চার ছেলে ও তিন মেয়ে। এলাকার পরিবেশ সুবিধার না হওয়ায় তিনি দুই ছেলেকে তাঁদের নানার বাড়িতে দিয়ে প্রথমে পড়াশোনা করিয়েছেন। পরে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। তাঁর তিন মেয়েও স্নাতক পাস। তাঁর তিন মেয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। চার ছেলের মধ্যে আবু ইউসুফ ও শামীমুল হাসান পড়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবু ইউসুফ এখন সিলেটের এমসি কলেজে সহযোগী অধ্যাপক ও শামীমুল হাসান শিক্ষকতা করছেন সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে। আরেক ছেলে রকিবুল ইসলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি সরকারি চাকরি করেন। আরেক ছেলে মাহমুদুল হাসান চাকরি করছেন এলাকার একটি কমিউনিটি ক্লিনিকে।

ছেলে শামীমুল হাসান বলেন, তাঁরা ছিলেন হাওরাঞ্চলের পিছিয়ে পড়ে জনগোষ্ঠী। পরিবারের সব ছেলে–মেয়ে লেখাপড়া করবে, এটা কেউ চাননি। চারজন সন্তান থাকলে দুজন পড়বে, দুজন কৃষিকাজ করবে—এটা ছিল অনেকটা নিয়মের মতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাঁর মা ছিলেন ব্যতিক্রম। তাঁর মা খুব হিসাব করে চলতেন। কোনো বিলাসিতা করেননি। মা সচেতন ছিলেন বলেই আজ তাঁরা নিজেরা স্বাবলম্বী। তাঁদের মা তাঁদের গর্ব।