৫২ বছর পর স্মৃতিস্তম্ভ
সামনে শহীদদের নামফলক। পেছনে বিশাল স্মৃতিস্তম্ভ। মাঝে মাটির কবরে ঘুমিয়ে আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ১৯৭১ সালে দেশকে স্বাধীন করার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁরা। রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁদের নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে। ঝিনাইদহের শৈলকুপার আবাইপুর ও কামান্নায় এই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। এই দুই স্থানে ৪৬ জনকে কবর দেওয়া হয়।
পাকিস্তানের দুঃশাসন ও শোষণের কবল থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত করতে জীবন উৎসর্গ করা এই ৪৬ শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর দীর্ঘদিন অযত্নে-অবহেলায় পড়ে ছিল। বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত এসব স্থানে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সেই দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এসব স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে সরকার। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস তুলে ধরতে এসব স্থানে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হওয়ায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা খুশি। তবে তাঁরা স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।
গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, শৈলকুপার বগুড়া ইউনিয়নের কামান্না মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের খেলার মাঠের পাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। যেখানে ঘুমিয়ে আছেন ২৮ শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আর আবাইপুর বাজারের পাশেই আরকেটি স্মৃতিস্তম্ভ। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবনের সামনে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে ১৯৭১ সালের ১৪ অক্টোবর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। স্থানীয় ব্যক্তিরা ১৮ জনের লাশ পেয়ে এই স্থানে কবর দেন। সেই ১৮ শহীদের নাম এখানে লেখা রয়েছে।
ঝিনাইদহ গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. ফারুক হোসেন জানান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার জন্য ব্যবহৃত বধ্যভূমিসমূহ সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার কামান্না ও আবাইপুরে দুটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। গণপূর্ত বিভাগ এই কাজ বাস্তবায়ন করেছেন। কামান্নায় প্রায় ১০ শতক জমির ওপর ৭১ লাখ ১৮ হাজার ৪১৪ টাকা ব্যয়ে ও আবাইপুরে প্রায় ১২ শতক জমির ওপর ৭১ লাখ ৯৮ হাজার ২৫০ টাকা ব্যয়ে স্মৃতিস্তম্ভ দুটি নির্মাণ করা হয়েছে। ২০২১ সালের এপ্রিলে কাজ শুরু হয়ে ২০২২-এর জুনে শেষ হয়েছে।
কামান্না গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী সিরাজুল ইসলাম জানান, মূলত কামান্নায় কোনো সম্মুখযুদ্ধ হয়নি। তারপরও স্থানীয় রাজাকারদের ষড়যন্ত্রে ২৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন দিতে হয়েছে। মাগুরা শ্রীপুর দখলমুক্ত করে ক্লান্ত ৪২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এসে পৌঁছান শৈলকুপার কামান্নায়। দলের নেতৃত্বে ছিলেন দুই তরুণ—আবু বকর ও আলমগীর হোসেন। দীর্ঘপথ হেঁটে সবাই আশ্রয় নেন গ্রামের মাধব চন্দ্র ভৌমিক ও ছামেলা বেগমের বাড়িতে। মাধব চন্দ্র ভৌমিকের বাড়ির গুদামঘরে ৩২ জন আর ছামেলা বেগমের বাড়িতে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।
কাজী সিরাজুল ইসলাম আরও জানান, রাতে স্থানীয় রাজাকাররা এই খবর পাঠিয়ে দেয় পাকিস্তান সেনবাহিনীর ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে স্থাপিত অস্থায়ী ও মাগুরা সদরের ক্যাম্পে। দুই পাশ থেকে রাতের আঁধারে কামান্নার দিকে এগিয়ে আসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে রাজকাররা। হানাদাররা চারদিক থেকে মাধব ভৌমিকের টিনের ঘর লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পাশেই ছামেলা বেগমের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া ১০ জনের মধ্যে পাঁচজন চাটাইয়ের বেড়া কেটে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হন। বাকি পাঁচজন উঠানেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
সিরাজ কাজী জানান, পাশের মাগুরা জেলার হাজিপুর বাহিনীর সদস্য হলেও কামান্নায় অবস্থানের কথা তাঁরা জানতেন। সে সময় কামান্না এলাকা মুক্ত থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা তেমন গুরুত্ব দেননি। সে কারণে শৈলকূপা এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা আজও সেই ব্যথা ভুলতে পারেন না। সকাল হয়, দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা ২৭টি লাশ এক জায়গায় করেন তাঁরা। সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। পরে ঘটনাস্থলে পাশেই কুমার নদের পাশে ৫টি যেখানে দীর্ঘ ৫২ বছর পর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
আবাইপুরের গল্পটা একটু ভিন্ন ধরনের। সেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সরাসরি যুদ্ধ হয়। সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বারইহুদা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশ্বাস লুৎফর রহমান বলেন, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। আবাইপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের দাপট ছিল। ১৩ অক্টোবর সকালে তাঁরা খবর পান, পাকিস্তানি বাহিনী মাগুরার শ্রীপুর খামারপাড়া বাজারে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে শৈলকূপার দিকে আসছে। এই খবরে তাঁরা হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তিনিসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে বাংকার খুঁড়ে অবস্থান নেন। স্থানীয় রাজাকারদের সাহায্যে এই খবর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা পেয়ে যায়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশ্বাস লুৎফর রহমান আরও বলেন, ১৪ অক্টোবর ভোররাতে হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা পেছন থেকে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেন। আধা ঘণ্টা চলে এই যুদ্ধ। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন।এই যুদ্ধে ৪১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকিস্তানি সেনাদের একজন কর্মকর্তাসহ তাদেরও বেশ কয়েকজন মারা যান। সকালে হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা চলে গেলে ঘটনাস্থলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ১৮ জনের লাশ ইউনিয়ন পরিষদের পাশে গণকবর দেওয়া হয়। অন্যদের কুমার নদের ধারে, পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসের পাশে কবর দেওয়া হয়।