চট্টগ্রামে বন্য হাতির মৃত্যু ঠেকাতে বন বিভাগ আসলে কী করছে
সারা দেশে বন্য হাতির সংখ্যা হাতে গোনা। ২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী, এই সংখ্যা মাত্র ২৬৮টি। এর মধ্যে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী, সাতকানিয়া ও লোহাগড়া—এ তিন উপজেলায় হাতি আছে ৩৫ থেকে ৪০টির মতো। তবে গত ১০ বছরে শুধু বাঁশখালী উপজেলায় ১৭টি হাতির অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। প্রায় প্রতিবছর হাতি মারা গেলেও হাতি রক্ষায় বন বিভাগ দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বন্য প্রাণী–বিশেষজ্ঞদের মতে, বন বিভাগের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা না থাকায় বন্য হাতির মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।
বন্য প্রাণী–বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাতি চলাচলের রাস্তা বা করিডর সংকুচিত হয়ে পড়া, হাতির আবাসস্থলে লোকালয় গড়ে তোলা, বনাঞ্চলে খাদ্যসংকট, বিদ্যুতের ফাঁদ বা বেড়ার এবং নানা রোগের সংক্রমণে হাতির মৃত্যু হচ্ছে। বন বিভাগ এসব ক্ষেত্রে থানায় ডায়েরি বা মামলা করেই দায় সারছে। এখন পর্যন্ত বন বিভাগ এ নিয়ে বড় কোনো প্রকল্প বা কর্মসূচি নেয়নি। বন্য প্রাণী রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হয়েও হাতির মতো বিপন্ন প্রাণী রক্ষার কোনো উদ্যোগই নেয়নি। এমনকি অসুস্থ হাতির শুশ্রূষারও নেই কোনো ব্যবস্থা।
বাঁশখালীতেই ১৭ হাতির মৃত্যু, বন বিভাগের ভূমিকা
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার দুটি বন রেঞ্জে গত ১০ বছরে ১৭টি হাতির মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে জলদী রেঞ্জে মারা গেছে ৬টি আর কালিপুর রেঞ্জে ১১টি হাতি। এসব হাতির মৃত্যু হয়েছে কৃষকের পেতে রাখা বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে, বনদস্যুদের আক্রমণে, ঝিরির কাদায় আটকে, পাহাড় থেকে পড়ে ও খাদ্যে বিষক্রিয়ায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাতির মৃত্যু ঘটেছে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে।
দেখা গেছে, বিদ্যুতের ফাঁদ অপসারণ, এলাকার কৃষকদের সচেতন করা, হাতির আক্রমণ ঠেকাতে রেসপন্স টিম গঠনের মতো কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেসব স্থায়ী হয়নি।
বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, হাতি রক্ষায় বন বিভাগের কাছে প্রশিক্ষিত জনবল নেই। দুর্গম পাহাড়ে কোনো কারণে হাতি আক্রান্ত কিংবা অসুস্থ হলে সেটি নিয়ে এসে চিকিৎসা করানোর মতো ব্যবস্থা নেই। এর বাইরে বনাঞ্চলগুলোতে যথেষ্ট জলাধার না থাকায় হাতি লোকালয়ে আসে এবং আক্রান্ত হয়।
বাঁশখালীতে ১০ বছরে ১৭টি হাতির মৃত্যু উদ্বেগজনক এবং এতে স্পষ্ট হয় যে হাতি সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ ছিল না
বন বিভাগের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাতি রক্ষার জন্য জরুরি ভিত্তিতে হাতির অভয়ারণ্যে নাগরিক সুবিধা বন্ধ করা দরকার। পাশাপাশি বন্ধ করে দিতে হবে নতুন রাস্তা তৈরির কাজও। এর বাইরে সভ্যতার ছোঁয়া থেকে দূরে রাখতে আলো বা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা প্রয়োজন। শুধু তা–ই নয়, পাহাড়ের পাদদেশে বা পাহাড়ের আশপাশে জনসাধারণের খতিয়ানভুক্ত জমিগুলো অধিগ্রহণ করে জনসাধারণের যাতায়াত কমিয়ে আনা এবং বনাঞ্চল বৃদ্ধি করা দরকার।
হাতির ১২টি করিডরের কী অবস্থা
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে জরিপ করে হাতির ১২টি হাতির চলাচলের পথের (করিডর) সন্ধান পায়। বাংলাদেশে হাতি চলাচলের জন্য চিহ্নিত এসব করিডরের মধ্যে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের তিনটি, উত্তর বন বিভাগের পাঁচটি এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের চারটি রয়েছে।
আইইউসিএন বাংলাদেশে যে ১২ হাতির করিডর চিহ্নিত করেছিল সরকার সেগুলো নির্দিষ্ট করে গেজেট প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, হাতির আবাসস্থল ও পরিবেশ টেকসই রাখতে, তাদের খাদ্য ও সুরক্ষা নিশ্চিতের পাশাপাশি চলাচলের করিডর উন্মুক্ত রাখার প্রতি সরকার গুরুত্ব দিয়েছে।
বন বিভাগ জানায়, ১২ করিডরের মধ্যে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন চুনতি-সাতগড় করিডর অনেকটা বন্ধ আছে। রেললাইন স্থাপনের কারণে এ করিডর দিয়ে হাতি চলাচল কমে এসেছে। ওই রেললাইনের কারণে চুনতি এলাকার হাতি চুনতিতে এবং বাঁশখালী এলাকার হাতি বাঁশখালীতে আটকা পড়েছে। এতে হাতির প্রজনন ও বংশবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বারবার একই এলাকায় হাতির প্রজনন হলে, হাতির আকার ছোট হয়ে আসে এবং ওই হাতিশাবক অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়। তাই সরকার স্বীকৃত ১২টি করিডরসহ অন্য করিডরগুলোতে নির্বিঘ্নে হাতি চলাচলের সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু এসব করিডরের অনেকগুলোতেই মানববসতি গড়ে উঠেছে।
গবেষকেরা যা বলছেন
চট্টগ্রামের বাঁশখালীসহ বিভিন্ন উপজেলায় হাতি নিয়ে বিভিন্ন সময় গবেষণা করেছেন বেঙ্গল ডিসকভারের প্রধান নির্বাহী ও বন্য প্রাণী সংরক্ষক আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাঁশখালীতে ১০ বছরে ১৭টি হাতির মৃত্যু উদ্বেগজনক এবং এতে স্পষ্ট হয় যে হাতি সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ ছিল না।
হাতি রক্ষায় বন বিভাগকে বেশ কিছু পরামর্শও দিয়েছেন আমিনুল ইসলাম। সেগুলো হলো হাতির করিডর বা চলাচলের পথ সংরক্ষণ ও পুনর্গঠন; বাঁশখালীসহ পাহাড়ি এলাকায় হাতির ঐতিহ্যগত চলাচলের পথগুলো চিহ্নিত করে সেখানে বসতি, চাষাবাদ বা শিল্পকারখানা নির্মাণ বন্ধ; হাতির চলাচলের পথ পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ; বিদ্যুৎ লাইনের নিরাপত্তা, জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ‘হিউম্যান-এলিফ্যান্ট কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট’ টিম পুনর্গঠন; আইন প্রয়োগে বন বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিকল্প খাদ্যের উৎস তৈরি।
জানতে চাইলে জলদী বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য রেঞ্জের কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ বলেন, সম্প্রতি হাতিশাবক হত্যার পর বাঁশখালীতে পাহাড়ের পাঁচটি ঘর বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন করে এসব ঘরে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরো অভয়ারণ্যে বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য গত ১৫ এপ্রিল বিদ্যুৎ বিভাগকে অনুরোধ করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে হাতির চলাচল ও খাদ্য সংগ্রহে ভালো প্রভাব পড়বে। তিনি আরও বলেন, হাতি রক্ষা ও গতিবিধি শনাক্ত করার জন্য জলদী অভয়ারণ্যে দুই দলে ২০ জন ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিমের (ইআরটি) সদস্য স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন।
বন্য প্রাণী–বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাতি চলাচলের রাস্তা বা করিডর সংকুচিত হয়ে পড়া, হাতির আবাসস্থলে লোকালয় গড়ে তোলা, বনাঞ্চলে খাদ্যসংকট, বিদ্যুতের ফাঁদ বা বেড়ার এবং নানা রোগের সংক্রমণে হাতির মৃত্যু হচ্ছে। বন বিভাগ এসব ক্ষেত্রে থানায় ডায়েরি বা মামলা করেই দায় সারছে। এখন পর্যন্ত বন বিভাগ এ নিয়ে বড় কোনো প্রকল্প বা কর্মসূচি নেয়নি। বন্য প্রাণী রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হয়েও হাতির মতো বিপন্ন প্রাণী রক্ষার কোনো উদ্যোগই নেয়নি। এমনকি অসুস্থ হাতির শুশ্রূষারও নেই কোনো ব্যবস্থা।
হাতি সংরক্ষণে বন বিভাগের প্রকল্প
হাতি সংরক্ষণে ‘হাতি সংরক্ষণ প্রকল্প’ নামে একটি নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বন বিভাগ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব ও হাতির মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় বন বিভাগ ওই সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে হাতির আবাসস্থল উন্নয়ন, নিরাপদ প্রজনন ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে হাতির খাদ্য উপযোগী বাগান, বেতবাগান ও বাঁশবাগান সৃজন করা হবে।
বন বিভাগ সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনের লক্ষ্যে ঝুঁকিপূর্ণ বনাঞ্চল ও গ্রামের মধ্যে ইকোলজিক্যাল সীমানায় সৌরবিদ্যুৎ-চালিত বেড়া তৈরি করা হবে। হাতির আবাসস্থলে দৈনন্দিন পানির চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য নিরাপদ জায়গায় ছোট-বড় জলাধার ও লবণের জলাশয় (সল্ট লেক) স্থাপন করা হবে বলে জানায় বন বিভাগ সূত্র।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আ ন ম ইয়াসিন নেওয়াজ বলেন, হাতি রক্ষায় এখন বন বিভাগ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি তৎপর। এ ক্ষেত্রে সরকারের উপদেষ্টা নিয়মিত মনিটরিং এবং পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, ‘হাতি রক্ষার জন্য হাতির আবাসস্থল সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এখন হাতির আবাসস্থল থেকে জবরদখল উচ্ছেদ করে প্রয়োজন অনুযায়ী হাতির খাদ্য উপযোগী উদ্ভিদ দিয়ে বনায়ন, জলাধার ও সল্ট লেক করার উদ্যোগ নিচ্ছি।’ হাতি হত্যার মামলাগুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রতিটি হাতি হত্যায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং মামলাগুলো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। হাতি সংরক্ষণের জন্য সম্প্রতি একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। এটি হলে দ্রুততার সঙ্গে কাজ শুরু করা হবে।
বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল ঢাকার বন সংরক্ষক (সিএফ) সানাউল্লাহ পাটোয়ারী বলেন, হাতি সংরক্ষণে হাতি সংরক্ষণ প্রকল্প নামে একটি নতুন প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এটি অনুমোদিত হলে হাতি সুরক্ষায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।