নেত্রকোনায় ৪১ ইটভাটার ৩৭টিই অবৈধ

এসব ভাটা বন্ধে আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে।

নেত্রকোনার কলমাকান্দা-ঠাকুরাকোনা সড়কের পাশে গুমাই নদের তীরে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হিরাকান্দা এলাকায় পিসিবি ব্রিকস নামের ইটভাটাটিতে কাঠ পুড়ানো হচ্ছে। ছবি সম্প্রতি তোলাপ্রথম আলো

নেত্রকোনায় ৯ উপজেলায় চালু থাকা ৪১ ইটভাটার ৩৭টিই আইন লঙ্ঘন করে কৃষিজমিতে, আবাসিক এলাকায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সড়ক ও রেলপথের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে। এসব ভাটায় ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট। কোনোটিতে কয়লার বদলে ইট পোড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ। এসব ভাটা বন্ধে আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩–এর ৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, কৃষিজমি, পাহাড় ও টিলার মাটি কেটে ইট তৈরি করা যাবে না। ওই আইনের ৬ নম্বরে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইট পোড়ানোর কাজে কাঠ ব্যবহার করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

যাঁরা নির্দেশ অমান্য করে অবৈধ ভাটার কার্যক্রম চলমান রেখেছেন, তাঁদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
শাহেদ পারভেজ, জেলা প্রশাসক, নেত্রকোনা

এ ছাড়া আইনের ৮ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর, সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান বা জলাভূমি, কৃষিজমি ও পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় ইটের ভাটা স্থাপন করা যাবে না। এ ছাড়া বনাঞ্চল, বিশেষ কোনো স্থাপনা, রেলপথ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল–ক্লিনিক ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে কোনো ইটভাটার ছাড়পত্র ও লাইসেন্স দেওয়া হবে না।

নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, এটা ঠিক নয়। প্রশাসন অবৈধ ইটভাটা বন্ধে কাজ করে যাচ্ছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা অবৈধ ভাটায় অভিযান পরিচালনা করে জরিমানাসহ কয়েকটি ভাটা ভেঙে দিয়েছেন। যাঁরা নির্দেশ অমান্য করে অবৈধ ভাটার কার্যক্রম চলমান রেখেছেন, তাঁদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

পরিবেশ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয় ও প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে কার্যক্রম চালু থাকা ইটভাটাগুলোর মধ্যে সদর উপজেলায় ৯টি, বারহাট্টায় ৪, কলমাকান্দায় ৫, দুর্গাপুরে ১, কেন্দুয়ায় ১০, আটপাড়ায় ২, মদনে ২, মোহনগঞ্জে ২ ও পূর্বধলায় ২টি।

এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে ২০২২ সালে নেত্রকোনা পরিবেশ অধিদপ্তরে তৎকালীন পরিদর্শক সুশীল কুমার দাস বাদী হয়ে নেত্রকোনা স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। আদালতের বিচারক সুহেল ম্রং ভাটাগুলোকে বিভিন্ন অঙ্কে জরিমানাসহ ওই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আইনসম্মত ও পরিবেশসম্মত স্থানে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। এ ছাড়া ইটভাটাগুলো ধ্বংসের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর নেত্রকোনা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালকে নির্দেশ দেন।

এ নির্দেশের বিরুদ্ধে সদরের ঠাকুরোকোনার মেসার্স এম আর এস ব্রিকস, দুর্গাপুরের মেসার্স পি এন কো ব্রিকসসহ কয়েকটি ভাটা পরিবেশ আদালতে আপিল করলেও পরিবেশ আদালত তা খারিজ করে দেন। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। অভিযান চালিয়ে কয়েকটি ভাটায় কেবল জরিমানা করে দায় সারে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, কলমাকান্দা-ঠাকুরাকোনা সড়কের পাশে ও গুমাই নদীর তীরে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হিরাকান্দা এলাকায় ‘পিসিবি ব্রিকস’ নামের ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। ওই ভাটার পাশে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। ভাটাতে ইট প্রস্তুতকারী একজন শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কয়লার দাম বেশি হওয়ায় কয়েক বছর ধরে এলাকার জঙ্গলগুলো থেকে কাঠ এনে ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে। অবশ্য এ জন্য সবকিছু ম্যানেজ করতে হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিসিবি ব্রিকসের মালিক দেলোয়ার হোসেন খানের মুঠোফোনের সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়।

ভাটাসংলগ্ন গুমাই বাজারের একজন ব্যবসায়ী বলেন, সাংবাদিকেরা ছবি তোলেন, পত্রিকায় লেখেন; কিন্তু কোনো লাভ হয় না। অবৈধ ইটভাটাটির ধোঁয়ার গন্ধে দম বন্ধ হয়ে যায়। গাছগাছালির ফল পর্যন্ত ঝড়ে যায়। মাত্র কয়েক শ গজ দূরে পনারপারুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। রাস্তা, বাজার, ঘরবাড়ি, নদী, ফসলি জমি সবকিছুর ক্ষতি হচ্ছে। এরপরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

নেত্রকোনা-মোহনগঞ্জ রেলপথের কাছে অন্তত চারটি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনায় সড়ক ও রেলপথ–সংলগ্ন মেসার্স এমআরএস ব্রিকসের মালিক খোকন চন্দ্র সিংহ। বারহাট্টা উপজেলার পাটলি গ্রামে রেলপথ ও প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষে আরএমবি ব্রিকসের মালিক আবুল খায়ের আকন্দ। তাঁদের দাবি, ইটভাটা স্থাপনের সময় পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দিয়েছে। ছাড়পত্র না দিলে ইটভাটা স্থাপন করতে পারতেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাঁচজন ইটভাটার মালিক প্রথম আলোকে জানান, প্রতিবছর কাস্টমস অধিদপ্তরকে ভ্যাট ছাড়াও উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের আলাদা আলাদা বখরা দিতে হয়। কেন্দুয়ার একটি ইটভাটার মালিক বলেন, সব দপ্তর মিলিয়ে প্রায় ৭ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া নামধারী কিছু সাংবাদিকদের তাণ্ডব তো আছেই।

পরিবেশ অধিদপ্তর নেত্রকোনা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আবু সাঈদ বলেন, মদনের মেসার্স সাদেক ব্রিকস, তুষার ব্রিকস, জবেদা ব্রিকস ও কলমাকান্দার দিদার ব্রিকস এই চার ভাটা বৈধ। বাকি ৩৭টি ভাটা অবৈধ। প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে অবৈধ ভাটা উচ্ছেদে অভিযান চালাচ্ছেন তাঁরা।