ট্রলারে ঝুঁকি নিয়ে পদ্মা নদী পার হচ্ছে মোটরসাইকেল

খরচ ও সময় বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারে করে মোটরসাইকেল পারাপার করছেন অনেকে। সম্প্রতি নড়িয়ার নওপাড়া এলাকার পদ্মার শাখা নদী থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল এখনো নিষিদ্ধ। এদিকে সেতু চালুর পর থেকে ফেরি চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। তাই বিকল্প হিসেবে ঝুঁকি নিয়ে অনেকে ট্রলারে করে মোটরসাইকেল পদ্মা নদীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে ঈদের আগে পদ্মা পারাপারে কোনো ব্যবস্থা করা না গেলে মোটরসাইকেলে চলাচলকারী দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ঈদযাত্রায় ভোগান্তিতে পড়বেন। এ ছাড়া ট্রলারে করে মোটরসাইকেলসহ নদী পাড়ি দিতে গিয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও আছে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি) ও সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, গত বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরদিন সেতুতে যান চলাচল শুরু হয়। প্রথম দিনে অন্তত ৪৫ হাজার যানবাহন পারাপার হয়। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ছিল ২৭ হাজার। ওই দিন রাতে সেতুতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই তরুণ নিহত হন। এরপর সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করে দেয় সেতু কর্তৃপক্ষ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ মূলত মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া-শিবচরের বাংলাবাজার ও শিমুলিয়া-জাজিরা নৌপথ ব্যবহার করে ঢাকায় যাতায়াত করতেন। এ অঞ্চলের অনেক মানুষ সহজে ঢাকায় যাতায়াতের জন্য মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন।

পদ্মা সেতু চালুর আগে মোটরসাইকেলের চালকেরা ফেরিতে পদ্মা নদী পারাপার হতেন। তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয় বিআইডব্লিউটিসি। এর পর থেকে বিপাকে পড়েন মোটরসাইকেলে চলাচলকারী মানুষ।

ফেরি বন্ধ ও সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞার পর অনেকে বিকল্প হিসেবে ট্রাক-পিকআপে মোটরসাইকেল তুলে দিয়ে পদ্মা সেতু পার হন। এতে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা গুনতে হয় তাঁদের। তবে লঞ্চে মোটরসাইকেল পারাপারে খরচ কিছুটা কম হয়। শিমুলিয়া-জাজিরা নৌপথে চারটি লঞ্চ চলাচল করছে। প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর একটি করে লঞ্চ জাজিরার সাত্তার মাদবর ও মঙ্গলমাঝির ঘাট থেকে শিমুলিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এসব লঞ্চে অনেকে মোটরসাইকেল পারাপার করছেন। লঞ্চে মোটরসাইকেল পারাপারে খরচ পড়ে ৮০০ টাকা। তবে লঞ্চে যাতায়াতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে। তাই খরচ ও সময় দুটি বাঁচাতে অনেকে ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারে করে মোটরসাইকেল পারাপার করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা নদীর দক্ষিণ পারের মানুষ জাজিরার সাত্তার মাদবর-মঙ্গল মাঝির ঘাট, পালেরচর ঘাট, বিলাশপুর ঘাট, নড়িয়ার নওপাড়া ঘাট, চরআত্রা ঘাট ব্যবহার করে। এই ঘাটগুলো থেকে একেকটি ট্রলারে সাত থেকে আটটি মোটরসাইকেল বোঝাই করে তা মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া, দিঘিরপার ও লৌহজং ঘাটে যায়। সেখান থেকে মোটরসাইকেলের যাত্রীরা ঢাকায় যান। এতে সময় লাগে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা। প্রতিটি মোটরসাইকেলে খরচ লাগে ৪০০ টাকা। সময় ও খরচে সাশ্রয়ী হলেও ছোট ইঞ্জিনচালিত এসব ট্রলারে উত্তাল পদ্মা পাড়ি দেওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। ট্রলারে কোনো লাইফ জ্যাকেটও রাখা হয় না।

নড়িয়ার মোক্তারের চর এলাকার রেজাউল করিম বলেন, ‘আমি নিয়মিত মোটরসাইকেল নিয়ে ঢাকায় যাতায়াত করি। আগে ফেরিতে পারাপার হতাম। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর আমাদের ভোগান্তি কমে যাবে ভেবে আনন্দিত হয়েছিলাম। কিন্তু সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল পারাপার বন্ধ। ফেরি চলাচলও বন্ধ। আমরা এখন বিপাকে পড়েছি। এখন বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারে পারাপার হচ্ছি।’

ট্রলারচালকেরাও ঝুঁকির বিষয়টি স্বীকার করেছেন। জানতে চাইলে বিলাশপুর ঘাটের ট্রলারচালক ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘নদীতে ঢেউ ও গভীরতা অনেক। এমনিতেই ছোট নৌকা ও ট্রলার চালানো ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ট্রলারে সাত-আটটি মোটরসাইকেল বোঝাই করে দক্ষিণ তীরের ঘাট থেকে মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে যাই। তবে নদী শান্ত থাকলে তেমন অসুবিধা হয় না।’

জাজিরার পালেরচর ঘাটের ট্রলারচালক সবুজ দেওয়ান বলেন, ‘মাঝেমধ্যে সাত-আটটি মোটরসাইকেল নিয়ে পদ্মা নদী পার হয়ে শিমুলিয়া ঘাটে যাই। প্রতিটি মোটরসাইকেল থেকে ৪০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। নদী পার হতে ৪০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা সময় লাগে।’

দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে ঈদের আগেই পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের দাবি জানিয়েছেন অনেকে। ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার মালিগ্রাম এলাকার ব্যবসায়ী সিহাব উদ্দিন বলেন, ‘ট্রাকে করে সেতু পার হতে হলে ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা গুনতে হচ্ছে। আবার লঞ্চে গেলে তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগছে। তাই খরচ ও সময় বাঁচাতে ট্রলারে পারাপার হচ্ছি। আমাদের ভোগান্তি কমানোর জন্য ঈদের আগে হয় সেতুতে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হোক, আর না হয় বিকল্প কোনো নিরাপদ ব্যবস্থা করুক। সরকারের কাছে সেই দাবি জানাচ্ছি।’

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের একজন প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতুতে আপাতত মোটরসাইকেল চলবে না। সেতুতে সিসিটিভি ক্যামেরা ও গতি নিয়ন্ত্রণযন্ত্র বসানো হচ্ছে। এসব যন্ত্র বসানোর কাজ শেষ হলে সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়া হতে পারে।

বিআইডব্লিউটিসির বাংলাবাজার ঘাটের ব্যবস্থাপক প্রফুল্ল চৌহান প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের আগে মোটরসাইকেল পারাপারের জন্য ফেরি চালানোর সম্ভবনা আছে। জাজিরার সাত্তার মাদবর ও মঙ্গলমাঝির ঘাটের পন্টুন সংস্কার করা হয়েছে। কবে থেকে ফেরি চলবে, কয়টি ফেরি চলবে, তা এখনো বলতে পারছেন না তিনি। এখনো সে রকম কোনো নির্দেশনা পাননি বলে জানান এই কর্মকর্তা।