‘জীবনখান বুঝি যায়’

ওএমএসের বিক্রয়কেন্দ্রে চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম থাকায় চাল-আটা পেতে ক্রেতাদের মধ্যে প্রতিদিনই হুড়োহুড়ির ঘটনা ঘটছে।

ঠাকুরগাঁওয়ে খোলাবাজারের (ওএমএস) বিক্রয়কেন্দ্রে মানুষের ভিড়। পৌর শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের পুরোনো বাসস্ট্যান্ড এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

সড়কের পাশে নারী-পুরুষের ভিড়। কেউ বসা, কেউ দাঁড়ানো। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে নারীদের শুরু হলো হুড়োহুড়ি-ধাক্কাধাক্কি। তা দেখে সেখান থেকে সরে এলেন বৃদ্ধ আছিয়া বেগম। বলতে লাগলেন, ‘কম দামে লাইনের চাল-আটা কিনিবা আসিয়া জীবনখান বুঝি যায়।’

ঠাকুরগাঁওয়ে দিন দিন খোলাবাজারের (ওএমএস) বিক্রয়কেন্দ্রে মানুষের ভিড় বেড়েই চলেছে। ক্রেতারা বলছেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দামে সাধারণ মানুষের সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তাই আগে যারা ওএমএসের লাইনে দাঁড়াতেন না, তাঁরাও আসছেন।

ওএমএসের বিক্রয়কেন্দ্রের লাইনে দাঁড়ানো লোকজন বলছেন, খুচরা বাজারে এক কেজি চাল কিনতে এখন ক্রেতাদের গুনতে হচ্ছে ৬০ টাকা। আর খোলাবাজারে প্রতি কেজি চাল ৩০ ও আটা ১৮ টাকায় মিলছে। সে হিসাবে প্রতি কেজি চালে ন্যূনতম ৩০ ও আটায় ৩৭ টাকা সাশ্রয় হচ্ছে তাঁদের। তবে চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম থাকায় চাল-আটা পেতে ক্রেতাদের মধ্যে প্রতিদিনই হুড়োহুড়ি এমনকি মারামারির ঘটনা ঘটছে। তারপরও অনেকে ফেরেন খালি হাতে।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ঠাকুরগাঁও কার্যালয় সূত্র জানায়, ঠাকুরগাঁও পৌর এলাকার ১২ ওয়ার্ডে ২৪টি ওএমএসের বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। সপ্তাহের ৬ দিন (সরকারি ছুটির দিন ছাড়া) ২৪ জন পরিবেশকের (ডিলার) মাধ্যমে এসব চাল বিক্রি করা হয়। প্রতিদিন একজন পরিবেশকের জন্য ৫০০ কেজি করে মোট ১২ মেট্রিক টন চাল ও ২৫০ কেজি করে ৬ মেট্রিক টন আটা বরাদ্দ দেওয়া হয়। একজন ক্রেতা প্রতি কেজি চাল ৩০ টাকায় এবং প্রতি কেজি আটা ১৮ টাকা দরে সর্বোচ্চ ৫ কেজি করে কিনতে পারেন। তবে এই বরাদ্দ থেকে টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডধারীদের মধ্যে চাল-আটা বিক্রির বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পুরোনো বাসস্ট্যান্ড এলাকার ওএমএস বিক্রয়কেন্দ্রে দেখা গেল, লাইনে ১১০ জন নারী চাল-আটা কেনার জন্য গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশের লাইনে পুরুষের সংখ্যা ছিল ৬৮। বেলা পৌনে ১১টার দিকে বিক্রয়কর্মী নারীদের লাইনের দিকে এগিয়ে এলেন। সবাই নিজেদের ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি বিক্রেতার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। দু-তিনজনের হাত থেকে নিতেই তাঁদের মধ্যে শুরু হলো হুড়োহুড়ি আর ধাক্কাধাক্কি। সে সময় কয়েকজন মাটিতে পড়ে গেলেন।

তাঁদের একজন শামসুন নাহার (৬১)। তিনি বলেন, ‘এইঠে থাকিয়া হামার মতো মানুষের চাল-আটা কিনিবার উপায় নাই। ঘরে চাল-আটা শেষ হয়ে গেইছে। প্রেশারের রোগী হয়াও লাইনত দাঁড়াইছু। একে তো গরমত কাহিল, তার ওপর আবার মানুষলার ধাক্কাধাক্কি। হামরা এইঠে টিকিমো ক্যামন করিয়া।’

সে সময় লাইনে দাঁড়ানো আছিয়া বেগম জানান, ভোরে এসে তাঁদের লাইনে দাঁড়াতে হয়। দোকান খোলে সকাল সাড়ে নয়টার পর। চার–পাঁচ ঘণ্টা দাঁড়িয়েও অনেকে চাল-আটা পান না।

এ সময় সালেহা খাতুন (৫৯) নামের এক নারী দুই হাতে দুটি ব্যাগ নিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন। এসেই মাটিতে বসে পড়লেন। তাঁর অবস্থা দেখে কেউ কেউ বাতাস শুরু করলেন। একজন দৌড়ে পানি এনে তাঁর মাথায় ঢালেন। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর তিনি বলেন, ‘অবস্থা কী দেখলেন? এখানে চাল-আটা পেতে গেলে যুদ্ধ করা লাগে। এখান থেকে চাল-আটা কেনার ফলে ৩৩৫ টাকা কম লাগছে। তাই কষ্ট হলেও লাইনে এসে দাঁড়াই।’

১২ নম্বর ওয়ার্ডের পরিবেশক এস এম ফারুক বলেন, বিক্রির জন্য তাঁরা প্রতিদিন ৫০০ কেজি চাল ও ২৫০ কেজি আটা বরাদ্দ পান। প্রত্যেক ক্রেতাকে ৫ কেজি চাল দিলে কেবল ৫০ জনকে দেওয়া যাবে। আর আটা দেওয়া যাবে মাত্র ২৫ জনকে। কিন্তু প্রতিদিন দুই শতাধিক মানুষ এখানে জড়ো হন। তাই সবার চাহিদা অনুযায়ী চাল-আটা দিতে পারছেন না।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ওএমএসের চাল-আটার বরাদ্দ সরাসরি মন্ত্রণালয় থেকে হয়। তাঁদের হাতে বরাদ্দ বাড়ানো-কমানোর সুযোগ নেই। তবে বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে মানুষের ভিড় বিবেচনা করে খাদ্য বিভাগ থেকে বরাদ্দ বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছে। সেটা অনুমোদন হলে বিক্রির জন্য পরিবেশকদের আরও বেশি পরিমাণে চাল-আটা বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হবে।