শহরে কখনো আসেননি, ছোট্ট রোমিওর পাশে উদ্বেগে বাবা, ঠাকুরমা

ছোট্ট রোমিওর শয্যার পাশে ঠাঁয় বসে আছেন তার ঠাকুরমা মিলন্তী ত্রিপুরা। আজ সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি ওযার্ডে
ছবি: প্রথম আলো

ছোট্ট রোমিও ঘুমাচ্ছে। নাকে নল। হাতে ক্যানুলা, স্যালাইন চলছে। শয্যার পাশে সার্বক্ষণিক পাহারায় ঠাকুরমা মিলন্তী ত্রিপুরা ও বাবা থবেন ত্রিপুরা। গুলিবিদ্ধ রোমিও যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে, ততক্ষণ তাঁদের শান্তি। জেগে থাকলে ব্যথা ও যন্ত্রণায় ছটফট করে। তার পেট এফোঁড়–ওফোঁড় করে গুলি বেরিয়ে গেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসাধীন সাত বছরের শিশুটির জীবনশঙ্কা কাটেনি এখনো।

রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের দুর্গম এক গ্রামের বাসিন্দা থবেন ত্রিপুরারা। একেবারে ভারতীয় সীমান্তবর্তী তুইচুই মৌজার গন্ডাছড়ার পার্শ্ববর্তী মারলং পাড়ায় তাঁদের বাস। বাংলা খুব একটা বলতে পারেন না তাঁরা। জুমচাষ করে চলেন। ওই দুর্গম এলাকায় রোববার দুপুরে দুই আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতি ও ইউনাইডেট পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের মধ্যে গোলাগুলির সময় ঘরের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয় রোমিও ত্রিপুরা।

অভাবী অনাহারী মানুষ থবেনের এ এক নতুন বিপদ। এক ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে রোমিও বড়। গুলি লাগার পর থেকে উদ্‌ভ্রান্তের মতো ছুটেছেন থবেন ও পাড়া প্রতিবেশী। গুলিতে ছেলের পেটের আঁত বেরিয়ে গেছে। তা আবার পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে কোনোরকমে রওনা হন তাঁরা চিকিৎসার আশায়। পায়ে হাঁটা পথ পেরিয়ে সাজেক রুইলুই ভেলিতে আসতেই রাত হয়ে যায় তাঁদের।

চমেক শিশু সার্জারি বিভাগের পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে দাঁড়িয়ে গতকাল মঙ্গলবার সকালে সেই উদ্বেগ–উৎকণ্ঠার সময়ের কথা জানালেন মিলন্তী ত্রিপুরা। ভাঙা ভাঙা বাংলা ও ত্রিপুরা ভাষায় তিনি বলেন, ‘গুলি লাগার পর পাড়া প্রধানদের কাছে যায় ছেলে। এরপর চিকিৎসার জন্য রওনা হতে হতে বিকেল হয়। পাঁচ ঘণ্টা পায়ে হেঁটে পৌঁছায় সাজেক। এরপর সেখান থেকে রাতে খাগড়াছড়ি। ওখান থেকে সোমবার সকালে এখানে (চমেক হাসপাতালে)।’

চমেক হাসপাতালে গতকাল সোমবার বেলা ১১টা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে রোমিওর অস্ত্রোপচার চলে। গুলিতে তাঁর পেলভিক বোন, ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদান্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রক্ত দিতে হয় কয়েক ব্যাগ। অস্ত্রোপচারের পর রোমিওর অবস্থা স্থিতিশীল বলে চিকিৎসক জানান। কিন্তু এখনো বিপদমুক্ত বলা যাচ্ছে না।

চমেক শিশু সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক খোরশেদ আলম সরোয়ার বলেন, তার ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদান্ত্রের ছিদ্র মেরামত করা হয়েছে। পেলভিক হাড়ে যে ক্ষত হয়েছে, তা সারতে সময় লাগবে। দীর্ঘ চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে শিশুটিকে। এখন সে স্থিতিশীল আছে।

দুর্গম পাহাড়ের মানুষ মিলন্তী ও থবেন ভাষাগত সমস্যায় চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে ঠিকমতো যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছেন না। পারবেনই–বা কীভাবে, এই প্রথম তাঁরা চট্টগ্রামে এসেছেন। এমনকি পাশের খাগড়াছড়ি বা রাঙামাটিতেও পা পড়েনি তাঁদের। রাজনীতিও তাঁরা বোঝেন না। তারপরও এই রাজনীতির আঁচে পুড়ে মরছে নিরীহ থবেনরা।

থবেন ভাঙা ভাঙা বাংলায় যা বললেন তা এমন, আগে কখনো চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়িতে যায়নি। এই প্রথম তাঁদের পাড়ায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। ঘরের ভেতর গুলিবিদ্ধ হওয়া ছেলেকে নিয়ে তাঁদের এই দুই জেলায় আসতে হলো। সামান্য টাকা নিয়ে এসেছেন ধার করে, তা–ও শেষ। অস্ত্রোপচারের পর ছেলের জ্ঞান ফিরলেও সুস্থ করে বাড়ি ফিরতে পারবেন কি না, এখনো জানেন না তিনি। এমন বিপদে তাঁরা কেবল সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছেন।