‘আমার ছেলেই নাই, তো আমি রেজাল্ট দিয়া কী করমু’
‘আমার ছেলের বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারছি, আমার ছেলে সবুজ এইচএসসি পরীক্ষায় ভালোভাবেই পাস করছে। কিন্তু আমার ছেলেই নাই, তো আমি রেজাল্ট দিয়া কী করমু?’ শেরপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শহীদ সবুজ মিয়ার মা মোছা. সমেজা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে আজ মঙ্গলবার বিকেলে কথাগুলো বলছিলেন।
গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেরপুর জেলা শহরের খরমপুর এলাকায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ছোড়া গুলিতে নিহত হন সবুজ মিয়া (১৯)। সবুজ শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার খড়িয়া কাজিরচর ইউনিয়নের পূর্ব রূপারপাড়া গ্রামের আজাহার আলীর ছেলে। তিনি চলতি বছর ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের অধীন শ্রীবরদী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। আজ সবুজের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যায়, সবুজ জিপিএ-৪.৩৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
কিন্তু পরীক্ষায় সবুজের পাসের খবরে পরিবারে আনন্দের পরিবর্তে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। সবুজের মা সমেজা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের ইচ্ছা ছিল, পড়ালেখা শেষ কইরা সরকারি চাকরি করব। আমগরে দুঃখ-কষ্ট দূর করব। কিন্তু কোথায় দুঃখ-কষ্ট দূর করব, উল্টা ও (সবুজ) শহীদ হইয়া আমগরে পরিবারে কষ্ট বাড়াইয়া দিয়া গেল। তবে দেশের ভালোর জন্য সবুজ শহীদ হইছে। এই জন্য কোনো দুঃখ নাই। আল্লাহ যেন ওরে বেহেশতবাসী করেন, এই দোয়া করি।’
সবুজের মা সমেজা আরও বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে সবুজ নিহত হলেও সরকারিভাবে তাঁরা কোনো সাহায্য পাননি। তবে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা, শ্রীবরদী সরকারি কলেজ থেকে ১ লাখ ও জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. মাহমুদুল হকের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছেন।
শহীদ সবুজের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, সবুজের বাবা আজাহার আলী পক্ষাঘাতগ্রস্ত। কোনো কাজ করতে পারেন না। তিন সন্তানের মধ্যে সবুজই বড়। অন্য দুই ভাই-বোন স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে। পড়ালেখার পাশাপাশি সবুজ স্থানীয় একটি ওষুধের দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। ওই আয় দিয়ে পরিবার ও নিজের পড়ালেখার খরচ মেটাতেন। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সবুজের মৃত্যুতে পরিবারটি আর্থিকভাবে চরম সংকটে পড়েছে।
শ্রীবরদী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ এ কে এম আলিফ উল্লাহ আহসান শহীদ সবুজ মিয়ার এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। প্রথম আলোকে বলেন, শহীদ সবুজ একজন মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। নিজে কষ্ট করে পড়ালেখা করতেন এবং সংসার চালাতেন। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
পরিবারটিকে আর্থিকভাবে সহায়তা করার জন্য সরকারের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।
এদিকে সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) পুলক কুমার রায় আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, শহীদ সবুজ মিয়া নিহতের ঘটনায় সদর থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। মামলার বাদী সবুজের ভাই সাদ্দাম হোসেন। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ২৫ জন।
পুলক কুমার রায় আরও বলেন, এ মামলায় আসামিদের মধ্যে রয়েছেন শেরপুর-১ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. ছানুয়ার হোসেন, শেরপুর-৩ (শ্রীবরদী-ঝিনাইগাতী) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ ডি এম শহিদুল ইসলাম, জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর রুমান, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল আলিম, সুজন মিয়া, সুব্রত কুমার দে, কানু চন্দ্র চন্দ, দেবাশীষ ভট্টাচার্য প্রমুখ। এ মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে। ইতিমধ্যে তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।