ঘাসফড়িংয়ের আক্রমণে আমনের ফলন কম

যশোর জেলার অনেক কৃষক আমন ধানের আশানুরূপ ফলন পাননি। প্রত্যাশার চেয়ে ধান কম হওয়ায় তাঁরা হতাশ হয়েছেন।

বাদামি ঘাসফড়িংয়ের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত আমন খেত। সম্প্রতি যশোরের অভয়নগর উপজেলার শিবনগর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

কৃষক রামপ্রসাদ দাস গত বছর এক বিঘা জমিতে ব্রি-৪৯ জাতের আমন ধানের চাষ করে ২২ মণ ধান পেয়েছিলেন। এবারও তিনি ওই জমিতে ব্রি-৪৯ জাতের আমন ধানের চাষ করেছেন। তিনি খেত থেকে ধান কেটে বাড়িতে এনে রেখেছেন। ওই জমিতে তাঁর এবার ১১ মণের বেশি ধান হবে না।

যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামের এই কৃষক বলেন, ‘এবার এক বিঘা (৪৮ শতকে বিঘা) জমিতে ব্রি-৪৯ জাতের আমন ধানের চাষ করেছি। এবার পুরো মৌসুমে কমবেশি বৃষ্টি হয়েছে। ধানে শিষ বের হওয়ার সময় বৃষ্টি হয়নি। তাতেও তেমন সমস্যা ছিল না। কিন্তু কারেন্ট (ঘাসফড়িং) পোকা সব শেষ করে দিয়েছে। পাঁচবার কীটনাশক স্প্রে করেও কোনো ফল পাইনি। জমিতে আমার ২২ মণের বেশি ধান হওয়ার কথা। কিন্তু এখন সেখানে ১১ মণ ধানও হবে না।’

বাঘারপাড়া উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামের কৃষক নন্দলাল রায় চলতি বছর দেড় বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। তিনি ধান কেটে মাড়াই করেছেন। তিনি বলেন, ‘জমি তৈরি থেকে শুরু করে ধানমাড়াই পর্যন্ত আমার খরচ হয়েছে ২৭ হাজার টাকা। ধানের শিষে যখন রং এসেছে, তখনই কারেন্ট পোকা আক্রমণ করেছে। পরপর দুই দিন ওষুধ দিয়েও পোকামুক্ত করতে পারিনি। ধানগাছ ও শিষ সাদা হয়ে যাচ্ছিল। এই অবস্থায় ধান কেটে মাড়াই করে ১৭ মণ ধান পেয়েছি। গত বছর ওই জমি থেকে ৩৮ মণ ধান পেয়েছিলাম।’

যশোরে এবার আমন ধানের ফলন ভালো হয়নি। কারেন্ট পোকা নামে পরিচিত বাদামি ঘাসফড়িংয়ের ব্যাপক আক্রমণ জেলার আমনখেত লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। জেলায় এখন পুরোদমে ধান কাটা চলছে।

ঘাসফড়িং আক্রমণের কারণে রামপ্রসাদ দাস ও নন্দলাল রায়ের মতো যশোর জেলার অনেক কৃষক আমন ধানের আশানুরূপ ফলন পাননি। প্রত্যাশার চেয়ে ধান কম হওয়ায় তাঁরা হতাশ হয়েছেন। আমন ধান চাষ করে তাঁদের এবার লোকসানও হয়েছে।

কৃষকেরা জানান, ঘাসফড়িংয়ের বৈশিষ্ট্য হলো, একগুচ্ছ ধানগাছে অসংখ্য পোকা আক্রমণ করে। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত পোকাগুলো পুরো গাছে ছড়িয়ে শুষে রস খায়। সকালে রোদ উঠলে পোকাগুলো গাছের গোড়ায় চলে যায় এবং সেখানে রস শুষে খায়। এভাবে একের পর এক খেতের ধানগাছ খেয়ে ফেলে। এতে ধানগাছ শুকিয়ে যায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর কার্যালয় সূত্র জানায়, এবার জেলার ১ লাখ ৪০ হাজার ৪০৬ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে। জেলার কিছু কিছু এলাকায় আমন খেতে কারেন্ট পোকা নামে পরিচিত বাদামি ঘাসফড়িংয়ের আক্রমণ হয়েছিল। কিন্তু পরে সেটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে কত হেক্টর জমিতে বাদামি ঘাসফড়িংয়ের আক্রমণ হয়েছে, তার কোনো তথ্য অধিদপ্তরে নেই।

অভয়নগর, বাঘারপাড়া ও মনিরামপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ খেতে আমন ধান পেকে গেছে। কৃষক ধান কাটছেন। কাটা ধান খেতে বিছিয়ে রোদে শুকাতে দিচ্ছেন। শুকানোর পর ছোট ছোট আঁটি করছেন। কোনো কোনো এলাকায় কৃষক ধান মাড়াই করছেন। মাড়াইয়ের পর সেই ধান বস্তায় ভরছেন।

যশোরের মনিরামপুর উপজেলার ভোজগাতী গ্রামের কৃষক শেখ রাসেল উদ্দীন গত বছর ৯ বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষ করে ২০৭ মণ ধান পেয়েছিলেন। এবারও তিনি ৯ বিঘা জমিতে ব্রি-৪৯, ব্রি-৮৭, গুটিস্বর্ণা ও ক্ষীরকোণ জাতের ধানের চাষ করেছেন। এ পর্যন্ত তিনি পাঁচ বিঘা জমির ধান কেটে বাড়িতে এনেছেন। এর মধ্যে দেড় বিঘা জমির ধান মাড়াই করে তিনি ৩০ মণ ধান পেয়েছেন।

শেখ রাসেল উদ্দীন বলেন, ‘ধানখেতে এবার ব্যাপক কারেন্ট পোকার আক্রমণ হয়েছে। ধান ফোলার মুখে দুইবার কীটনাশক স্প্রে করেছি। তাতে খুব একটা কাজ হয়নি। ধানের ফলন ভালো হচ্ছে না। এবার সব মিলিয়ে ১৮০ মণের মতো ধান হতে পারে।’

অভয়নগর উপজেলার শংকরপাশা ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা দেবব্রত সরকার বলেন, এই ব্লকে প্রচুর পরিমাণে শর্ষে চাষ হয়। এ জন্য কৃষক আগাম জাতের আমন ধানের চাষ করেন। যাঁরা আগাম জাতের ধানের চাষ করেছেন, তাঁদের খেতে বাদামি ঘাসফড়িংয়ের আক্রমণ হয়নি। তাঁদের ফলনও ভালো হয়েছে। তবে যাঁরা নাবি জাতের ধান চাষ করেছেন, তাঁদের খেতে বাদামি ঘাসফড়িংয়ের বেশ আক্রমণ হয়েছে। তাঁদের ফলন অর্ধেক হচ্ছে।

বাঘারপাড়া উপজেলার বাসুয়াড়ী ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবদুল করিম খান বলেন, ‘আমার ব্লকে আমন খেতে বাদামি ঘাসফড়িংয়ের আক্রমণ ছিল। কিছু ক্ষতিও হয়েছে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাঘারপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাসরিন জাহান বলেন, উপজেলার কিছু কিছু এলাকায় আমনখেতে বিক্ষিপ্তভাবে বাদামি ঘাসফড়িংয়ের আক্রমণ হয়েছিল। কিন্তু কৃষকেরা কীটনাশক স্প্রে করায় এবং ওই সময় বৃষ্টি হওয়ায় আক্রমণ কমে যায়। তিনি বলেন, বাদামি ঘাসফড়িং থাকে ধানগাছের গোড়ার দিকে, কিন্তু কৃষক কীটনাশক স্প্রে করেন গাছের ওপরের দিকে। এ কারণে অনেক জায়গায় খেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মঞ্জুরুল হক বলেন, জেলার কিছু কিছু এলাকায় এবার আমন খেতে বাদামি ঘাসফড়িংয়ের আক্রমণ হয়েছে। এতে এলাকাভিত্তিক আমনের ফলন কিছুটা কম হচ্ছে।