‘মায়ের ওষুধ কিনমু না মাইয়ার লাগি দুধ কিনমু, ধন্দে থাকি’

রিকশাচালক শামীম আহমদ
ছবি: প্রথম আলো

টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ায় দুই বছর বয়সে তাঁর বাঁ পা চিকন হয়ে যায়। চার বছর বয়সে হারিয়েছেন বাবাকে। এরপর ছেলেকে মা-ই কোলেপিঠে বড় করেছেন। একসময় ছোট ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার পাতেন। বয়স হওয়ায় মাও আগের মতো মানুষের বাড়িতে কিংবা রেস্তোরাঁয় কাজে যেতে পারেন না। স্বামী ভবঘুরে হওয়ায় বিবাহিত বোনও একসময় দুই সন্তানকে নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে হাজির হন।

মা, বোন আর বোনের সন্তানদের নিয়ে শুরু হয় শামীম আহমদের (২৬) সংগ্রামমুখর জীবন। তিনি এখন সিলেট শহরে অটোরিকশা চালান। এ থেকে সীমিত আয় হয়। এই আয়েই তাঁকে সংসার চালাতে হচ্ছে। এর মধ্যে তিনি বিয়ে করেছেন, তাঁর মেয়েটার বয়স সোয়া এক মাস। জন্মের পর থেকে মেয়ে মায়ের বুকের দুধ পায় না। তাই মেয়েকে গুঁড়া দুধ খাওয়াতে হচ্ছে। টাকার অভাবে অসুস্থ মায়ের ওষুধও নিয়মিত কিনে দিতে পারেন না। এভাবেই কষ্টে চলছে শামীমের দিনরাত।

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার খুশা খাগাউড়া গ্রামে শামীমদের বাড়ি। ১৯৯৮ সালে তাঁর টাইফয়েড হয়, সেবার তাঁর বাবা সপরিবার সিলেটে চলে আসেন। এর কয়েক বছর পর শামীমের ঠিকাদার বাবা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন বাসা ও রেস্তোরাঁয় গৃহপরিচারিকার কাজ করে মা তাঁদের দুই ভাই ও এক বোনকে বড় করেন। শারীরিক সমস্যার কারণে শামীম ভারী কাজ করতে পারেন না। তাই অটোরিকশা চালানোকেই একসময় পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি। টানা আট বছর ধরে তিনি এ পেশায় আছেন।

গতকাল শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত শামীমের সঙ্গে কথা হয়। তাঁর বাসা নগরের পনিটুলা এলাকায়। ওই এলাকার মূল সড়কে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাটি মালিকের কাছ থেকে ৩০০ টাকায় ভাড়া নিয়ে তিনি শহরের অলিগলিতে যাত্রী পরিবহন করেন।

মালিকের ভাড়া শোধ করে তাঁর হাতে প্রতিদিন ৫০০ টাকার মতো থাকে। প্রতি মাসে তাঁর আয় গড়ে ১৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে ঘরভাড়া ৪ হাজার টাকা, বিদ্যুৎ বিল ১ হাজার টাকা, মেয়ের গুঁড়া দুধের জন্য ২ হাজার ৪০০ টাকা, ঋণের কিস্তি পরিশোধ বাবদ ৫ হাজার ৬০০ টাকা খরচ হয়। বাকি টাকাতে কোনো রকমে খাওয়াসহ সংসারের খরচ মেটান।

শামীম বলেন, ছোট বোনকে দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছিলেন। তবে বিয়েটা সুখের হয়নি। বোনের স্বামী ভবঘুরে হয়ে এখানে–সেখানে ঘুরে বেড়ান। তাই কয়েক বছর ঘুরতেই দুই মেয়েকে নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে চলে এসেছেন বোন। বড় ভাগনি তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ছোট ভাগনি প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে। তাদের পড়াশোনার খরচ শামীমকেই বহন করতে হয়। ২০১৬ সালে বিয়ে করেন তিনি। মেয়ের জন্য প্রতি সপ্তাহে ৬০০ টাকার এক কৌটা গুঁড়া দুধ কিনতে হচ্ছে।

শামীমের ভাষ্য, গত মে মাসে এক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কিনেছিলেন তিনি। জুন মাসের মাঝামাঝি সিলেটে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিলে জেলা স্টেডিয়ামের সামনে একটি সংগঠনের উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। ত্রাণের আশায় ওই দিন শামীম অটোরিকশাটি স্টেডিয়ামের ফটকের বাইরে রেখে ভেতরে ঢোকেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ত্রাণ না পেয়ে তিনি বাইরে এসে দেখেন, অটোরিকশাটি চুরি হয়ে গেছে। এর পর থেকে তিনি অন্য একটি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছেন। তবে অটোরিকশা কেনার জন্য যে টাকা ঋণ করেছিলেন, এর কিস্তি প্রতি মাসে ঠিকই দিতে হচ্ছে।

সীমিত আয় দিয়ে আট সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে গিয়ে শামীম হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানান। তিনি বলেন, সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় নিত্যপণ্যের দাম আরেক দফা বেড়েছে। এ কারণে খাবারদাবারের খরচও বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় এখন যে বাসায় ভাড়া থাকেন, সেটি চলতি মাসেই ছেড়ে দেবেন। খরচ বাঁচাতে আগামী ১ সেপ্টেম্বর দরজিপাড়া এলাকায় অন্য আরেকটা বাসায় উঠবেন পরিবার নিয়ে। ওই বাসার ভাড়া প্রতি মাসে ২ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হবে। কালেভদ্রে মাছ-মাংস খান। ভাতের সঙ্গে ডাল আর আলুই তাঁদের ভরসা। প্রতি মাসেই তাঁকে ধারকর্জ করতে হয় বলে জানান।

শামীম আলাপে আলাপে বলেন, ‘যে কঠিন সময় আইছে, চলা টাপ অই গেছে। বিপদে পড়লে পাঁচ টাকা বের করার ক্ষমতা নাই। টাইনাটুইননা কুনুরকমে চলতাছি। বউয়ের (স্ত্রী) ভাই গত ঈদে কিছু টেকা দিছল, সেই টেকা দিয়া কাপড় কিনছি। গত এক বছরের মইধ্যে ওইটাই কাপড় কিনা। মায়ের হার্টের সমস্যা, হাইপ্রেশারও আছে। ডাক্তার দেখাইছি। ডেইলি ৫০ টেকার ওষুধ লাগে মায়ের। টেকা যেদিন বেশি ইনকাম করি, সেদিন মায়ের লাগি ওষুধ কিনি। টেকা কম ইনকাম করলে মায়ের ওষুধ কিনতাম পারি না। মায়ের ওষুধ কিনমু, না মাইয়ার লাগি গুঁড়া দুধ কিনমু, ধন্দে থাকি।’

কথায় কথায় রাত বাড়ে। ঘড়ির কাঁটা দেড়টার ঘরে যখন পৌঁছে, শামীম তখন কথা শেষ করে বাসায় ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ান। বলেন, সকাল ১০টায় অটোরিকশা নিয়ে বেরিয়েছিলেন। এখন বাসায় ফিরছেন। এটাই তাঁর প্রতিদিনকার রুটিন। বিদায় নেওয়ার আগে শামীম বলে যান, আগের ঋণ শোধ হলে আরেকটা নতুন অটোরিকশা কিনবেন। তখন তাঁর দুঃখ অনেকটাই ঘুচে যাবে, সেই আশা করছেন। নিজের স্বপ্নের কথা শুনিয়ে নির্জন রাস্তা ধরে অটোরিকশা নিয়ে এগিয়ে যান শামীম।