শিক্ষক সমিতি ও অথরিটি নির্বাচন ঘিরে আওয়ামীপন্থীদের ‘কোন্দল’ প্রকাশ্যে

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ফাইল ছবি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও ‘অথরিটি’ (ডিন-সিন্ডিকেট) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রগতিশীল ও আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন হলুদ প্যানেলে ‘কোন্দল’ দেখা দিয়েছে। প্যানেলের স্টিয়ারিং কমিটির মনোনয়ন না পেয়ে ১২ জন শিক্ষক বিভিন্ন পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এ ছাড়া স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী শিক্ষকদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ দল থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে।

সিন্ডিকেট নির্বাচনে অংশ নেওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেখানে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের বিপরীতে দলীয় সদস্যদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেওয়ার বিষয়টিকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘গণতন্ত্রের সৌন্দর্য’ বলেছেন, সেখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের স্টিয়ারিং কমিটি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কটাক্ষ করছেন এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ দল থেকে বহিষ্কারের হুমকি দিয়েছেন। স্টিয়ারিং কমিটির নীতিনির্ধারকেরা তাঁদের ঘনিষ্ঠতম ও অনুগত শিক্ষকদের মনোনয়ন দিয়েছেন বলে অভিযোগ স্বতন্ত্রদের।

তবে স্টিয়ারিং কমিটির নেতারা বলছেন, কমিটির সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতেই প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ দল থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়ার বিষয়টি মিথ্যা। কিছু শিক্ষক ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এটি দলগত কোন্দলের অংশ নয়। দলের বাইরে গিয়ে যাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন, তাঁরা আসলে ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার জন্য এ কাজ করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ১২ ডিসেম্বর শিক্ষক সমিতি ও অথরিটি নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেশের চলমান পরিস্থিতিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে এই নির্বাচন দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন বিএনপি ও জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা প্যানেলের সদস্যরা। তবে কর্তৃপক্ষ নির্বাচনের নতুন তারিখ নির্ধারণ করে ১৭ ডিসেম্বর। এদিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনে ভোট গ্রহণ চলবে। গত ৬ ডিসেম্বর ছিল মনোনয়ন প্রত্যাহারের সময়। ইতিমধ্যে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন হলুদ প্যানেলের মনোনীত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এবং সাদা প্যানেলের একাংশ মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে।

হলুদ প্যানেল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি পদে মনোনয়ন পেয়েছেন প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাবিবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনয়ন পেয়েছেন মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক সরকার। অন্যদিকে হলুদ প্যানেল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে সাধারণ সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী।

সিন্ডিকেট সদস্য নির্বাচনে পাঁচটি পদের বিপরীতে হলুদ প্যানেল থেকে চারজন শিক্ষক মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। তাঁরা হলেন প্রাধ্যক্ষ ক্যাটাগরিতে অধ্যাপক হাসনা হেনা, অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে মাহমুদুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে সোলাইমান চৌধুরী এবং সহকারী অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে তানজিল ভূঞা।

এদিকে হলুদ প্যানেল থেকে সিন্ডিকেট নির্বাচনে মনোনীত শিক্ষকেরা হলেন প্রাধ্যক্ষ ক্যাটাগরিতে সৈয়দ আমীর আলী হলের প্রাধ্যক্ষ এ কে এম মাহমুদুল হক, অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে রসায়ন বিভাগের হাসান মাহমুদ, সহযোগী অধ্যাপক পদে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের খালিদ বিন ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক পদে ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স বিভাগের রাকিবুল ইসলাম এবং প্রভাষক পদে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের রিজু খন্দকার।

ডিন নির্বাচনে হলুদ প্যানেল থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন বিভিন্ন অনুষদের অধ্যাপক মিজানুর রহমান খান, অধ্যাপক আবু নাসের মো. ওয়াহিদ, অধ্যাপক নাসিমা আখতার, অধ্যাপক এ এস এম কামরুজ্জামান, অধ্যাপক এস এম একরাম উল্লাহ, অধ্যাপক যুগল কুমার সরকার, অধ্যাপক বিমল কুমার প্রামাণিক, অধ্যাপক মোস্তফা শরিফ আনোয়ার, অধ্যাপক মজিবুল হক আজাদ খান, অধ্যাপক এ এইচ এম সেলিম রেজা, অধ্যাপক আবদুস সামাদ, অধ্যাপক জালাল উদ্দিন সরদার।

অন্যদিকে অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম, অধ্যাপক আমিনুল হক, অধ্যাপক আরিফুর রহমান, অধ্যাপক রোকনুজ্জামান, অধ্যাপক ফজলুল করিম, অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, সহযোগী অধ্যাপক রাইসুল ইসলাম হলুদ প্যানেল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিভিন্ন অনুষদের ডিন নির্বাচনে লড়ছেন।

সিন্ডিকেট নির্বাচনে সহযোগী অধ্যাপক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সোলাইমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টে বলা হয়েছে। যাঁরা ব্যক্তিস্বার্থের কথা বলছেন, তাঁরা আসলে ভাগ-বাঁটোয়ারার রাজনীতি করছেন। সামনে যেহেতু শিক্ষক নিয়োগ আছে, এ জন্য স্টিয়ারিং কমিটির নীতিনির্ধারকেরা তাঁদের ঘনিষ্ঠতম ও অনুগত শিক্ষকদের মনোনয়ন দিয়েছেন, যাতে নিয়োগ–বাণিজ্য ও আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো যায়। মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় প্রতিশ্রুতি ও জ্যেষ্ঠতা বিবেচনা করা হয়নি, বরং আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের কাজ প্রগতিশীল চিন্তার পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেন শিক্ষক সোলাইমান চৌধুরী।  

কোন্দলের বিষয়টি অস্বীকার করে স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, হলুদ প্যানেলে কোনো কোন্দল নেই। কিছু শিক্ষক ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এটি দলগত কোন্দলের প্রকাশ নয়, বরং ব্যক্তিমানুষের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। তাঁদের বিষয়ে কিছু বলার নেই। স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

বিরোধী প্রার্থী না থাকায় নির্বাচিত যাঁরা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও বিভিন্ন অথরিটি নির্বাচনে বিরোধীদলীয় সাদা প্যানেলের কোনো প্রার্থী ও হলুদ প্যানেল থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকায় হলুদ প্যানেলের মনোনীত দুই ক্যাটাগরির সাতজন শিক্ষক ভোট গ্রহণের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

প্রভাষক পদে সিন্ডিকেট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের রিজু খন্দকার। শিক্ষা পরিষদের (একাডেমিক কাউন্সিল) সহযোগী অধ্যাপক পদে হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের মো. মনিরুজ্জামান, নৃবিজ্ঞান বিভাগের মোস্তাফিজুর রহমান, ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিভাগের ইমতিয়াজ আলম নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া সহকারী অধ্যাপক পদে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুহাম্মদ কামরুল হাসান, বাংলা বিভাগের গৌতম গোস্বামী এবং চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগের নাজিয়া আফরিন নির্বাচিত হয়েছেন।

গত ১৪ বছরে বিএনপি-জামায়াতপন্থী কোনো শিক্ষকের নিয়োগ না হওয়ায় শিক্ষকসংকটের কারণে সাদা প্যানেল প্রার্থী দিতে পারেনি বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি এফ নজরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই সরকারের আমলে গত ১৪ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের দলের কোনো শিক্ষকের নিয়োগ হয়নি। এ কারণে তাঁদের প্রার্থীর সংকট দেখা দিয়েছে। যে কয়জন সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন, তাঁরা পদোন্নতি পেয়ে অধ্যাপক হয়েছেন। হাতে গোনা যে দু-একজন আছেন, তাঁদের সিন্ডিকেট নির্বাচনে প্রার্থী করা হয়েছে।