অপরিকল্পিত উন্নয়নে মৃতপ্রায় 

  • একসময়ের দেড় শ মিটার প্রশস্ত শোলমারী দু-তিন মিটারের সরু নালায় পরিণত হয়েছে।

  • নদীর মধ্যে জলকপাট নির্মাণ করা হয়েছে। এতে পলি পড়ে চরের সৃষ্টি হয়েছে।

  • নদীতে ইটভাটাসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এতে পানিনিষ্কাশন বন্ধ হয়ে গেছে।

পলি পড়ে প্রায় ভরাট হয়ে গেছে শোলমারি নদী। ভাটার সময় নদীতে পানি থাকে না। রোববার বটিয়াঘাটা উপজেলার শোলমারী এলাকায়
প্রথম আলো

একসময় শোলমারী নদীতে প্রবল স্রোত ছিল। বড় বড় নৌকা ও কার্গো চলাচল করত। জেলেরা জাল ফেলে ধরতেন মাছ। এখন এসব অতীত। পলি পড়ে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় ও অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজের কারণে একসময়ের দেড় শ মিটার প্রশস্ত শোলমারী দু-তিন মিটারের সরু নালায় পরিণত হয়েছে। ভাটার সময় এখন নদীতে আর নৌকা চালানো যায় না। হেঁটেই নদীর এক পার থেকে অন্য পারে যায় মানুষ। 

নদীটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া ও খুলনা শহরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে বলে নদীবিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিলে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ ব্যাহত হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ শোলমারী নদীটি খুলনার বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলার ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে। নদীটির উৎসমুখ বিল ডাকাতিয়ায়। এরপর এটি গুটুদিয়ার মধ্য দিয়ে কৈয়া সেতুর নিচ দিয়ে এসে শোলমারী খেয়াঘাট এলাকায় বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে বটিয়াঘাটা সেতুর নিচ দিয়ে কাজীবাছা নদীতে পড়েছে। কাজীবাছা সুন্দরবনের নদ পশুরে গিয়ে মিলেছে। এদিকে শোলমারী খেয়াঘাটের ডান দিকে শোলমারী নদীর আরেকটা প্রবাহ সালতা-ভদ্রার প্রবাহের সঙ্গে মিলে দক্ষিণে সুন্দরবনের আরেক নদী শিবসার দিকে প্রবাহিত হয়েছে।

নদীটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া ও খুলনা শহরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে। 

পাউবো ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৫-৩০ বছর আগে শোলমারী খেয়াঘাট এলাকায় যেখানে শোলমারী নদী বাঁক নিয়ে কাজীবাছার দিকে গেছে, সেখানে প্রচুর পলি জমতে থাকে। পলি জমতে জমতে একসময় বাঁকের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এতে কৈয়া, জিলেরডাঙ্গা এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। তখন বাঁকের মুখ থেকে কিছুটা দক্ষিণ দিকে সরে এক কিলোমিটারের মতো নদীর চর খনন করে কৈয়া বাজারের দিকের পানির সচল প্রবাহের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়। 

পাউবো সূত্র জানায়, ২০০০ সালের দিকে শোলমারী খেয়াঘাটসংলগ্ন এলাকায় একটি ১০ কপাটের জলকপাট (টেন ভেন্ট স্লুইসগেট) নির্মাণ করা হয়। নদীর মধ্যে জলকপাট নির্মাণ করায় শোলমারী নদী মূলত দুই অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর চর পড়ে যাওয়া নদীর জায়গায় মাছের ঘের, ইটভাটা এসব গড়ে উঠতে থাকে। তারপরও বিলডাকাতিয়া, কৈয়া অঞ্চলের পানি আপার শোলমারী অংশ দিয়ে জলকপাট হয়ে মূল প্রবাহে গিয়ে পড়ত। তবে গত দুই বছরে ১০ কপাটের জলকপাটের কপাটগুলো পলি জমে পুরো বন্ধ হয়ে গেছে। জলকপাটের মুখ থেকে পলি অপসারণ করা হলেও আবারও তা বন্ধ হয়ে গেছে। 

গত ১৬, ১৭ ও ১৯ আগস্ট শোলমারী নদীর পতিতমুখ কাজীবাছা নদী থেকে শুরু করে শোলমারী নদীর দুই পাড় ও আপার শোলমারী অংশের এলাকা ঘুরে নদীটির করুণ চিত্র চোখে পড়েছে। ওই তিন দিনে নদীতে কোনো রকম নৌকা বা নৌযান চলতে দেখা যায়নি। বটিয়াঘাটা সেতুর কাছে নদীটি সব মিলিয়ে দু-তিন মিটার চওড়া আছে। এরপর থেকে শোলমারী খেয়াঘাট পর্যন্ত একই অবস্থা। নদীর দুই পারে বিশাল চর। জোয়ার এলে ডুবে যায়, ভাটায় আবার ভেসে ওঠে। 

স্থায়ী জলাবদ্ধতা ও ফসলের আবাদ নিয়ে শঙ্কা

শোলমারী নদীর পারের মানুষ মূলত কৃষিনির্ভর। বর্ষাকালে নদী থেকে জলকপাটের মাধ্যমে মিষ্টি পানি তুলে তাঁরা সেচের চাহিদা মেটান। জলকপাটগুলো পলি পড়ে বন্ধ হওয়ায় তাঁরা বিপাকে পড়েছেন। 

বটিয়াঘাটার চক শোলমারী গ্রামের অমল সরকার বলেন, ‘অন্যবছর এরকম সময় আমন লাগানো শেষ হয়ে যায়। এবার এখনো চাষাবাদই শেষ করতে পারিনি। বৃষ্টি কম হওয়ায় বিল একবারে শুকনা। আবার নদী ভরাট হয়ে গেছে। জলকপাটের সামনে পলি পড়েছে। বিলে ঠিকমতো পানি তোলা যাচ্ছে না।  বিলের খালগুলোও ভরাট হয়ে গেছে। আবার বেশি বৃষ্টি হলেও নিষ্কাশনের অসুবিধা। বিল নিচু কিন্তু নদীর বুক বিলের চেয়ে অনেক উঁচু হয়ে গেছে। এবার ধান লাগাতে পারলেও হয়তো আগামী বছর থেকে আর সম্ভব হবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন হোগলবুনিয়া গ্রামের  ইলিয়াস হাওলাদার।

শোলমারী নদীতে ইলিশ, চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরে সংসার চালাতেন উত্তর হোগলবুনিয়ার সুজন মণ্ডল। কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, নদীতে মাছ নেই। নৌকাও চলে না। নদীর সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।

বটিয়াঘাটা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবু বকর সিদ্দিক জানান, বটিয়াঘাটার কৃষির জন্য শোলমারী নদীর গুরুত্ব অনেক বেশি। সেচ এবং পানিনিষ্কাশন—দুই ক্ষেত্রেই নদীর দরকার। শোলমারী নদীর যে অবস্থা হয়েছে, তাতে শিগগিরই কৃষিতে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা উপজেলার অন্তত ৫০টি গ্রামসহ বিল ডাকাতিয়া এলাকার পানি এই শোলমারী নদী দিয়েই নিষ্কাশিত হয়। নদীটি  না থাকলে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সমস্যা তৈরি হতে পারে।

 পাউবো খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, শোলমারীতে জোয়ার দুই দিক দিয়ে ঢোকে, যাকে টাইডাল মিটিং পয়েন্ট বলে। এ জন্য এখানে পলি জমার হারটা বেশি। শোলমারী নদী নিয়ে একটা স্টাডি চলমান রয়েছে। সেটা শেষ হলে নদী ভরাট কীভাবে বন্ধ করা যায়, সে বিষয়টি জানা যাবে।