কিশোরগঞ্জের যে ঢাকের হাটের ঐতিহ্য ৪০০ বছরের

দুর্গাপূজার অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে ঢাক ও ঢোলের চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর কটিয়াদীর পুরান বাজার এলাকায় হাট বসে। বাদক দলের দক্ষতা দেখে পূজামণ্ডপের জন্য ঢাকিদের নেওয়া হয়ছবি: তাফসিলুল আজিজ

দুর্গাপূজা ঘিরে বসা কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর ঢাকের হাটের ঐতিহ্য ৪০০ বছরের। মহাষষ্ঠীর প্রতিমার আসনে প্রতিস্থাপন থেকে বিসর্জন—দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতার সবখানেই ঢাকের বাজনা চাই-ই চাই। দুর্গাপূজার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকতার প্রধান অনুষঙ্গ ঢাকের চাহিদা মেটাতে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে প্রতিবছরের মতো এবারও বসে ‘ঢাকের হাট’।

মণ্ডপে বাদ্য বাজানোর প্রয়োজনে দর–কষাকষির মাধ্যমে পূজারিদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া এই হাটের রীতি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগের বছরের তুলনায় এবার বেড়েছে মণ্ডপের সংখ্যা। এই সংখ্যা বাড়লেও ঢাক ও ঢাকির সংখ্যা বাড়েনি। বেড়েছে ঢাকিদলের চুক্তিবদ্ধ হওয়ার অর্থমূল্য।

হাট থেকে ঢাকিদল নিতে কিশোরগঞ্জ থেকে এসেছেন কৃষ্ণ চন্দ্র রায় নামের একজন। ৮৫ হাজার টাকায় ছয়জনের একটি ঢাকিদলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। দলটির প্রধান সন্তোষ চন্দ্র।

কৃষ্ণ চন্দ্র রায় বলেন, গত বছরও একই মণ্ডপের জন্য ছয়জনের একটি দল নিয়ে গেছেন ৫০ হাজার টাকায়। এবার একই সদস্যের দলটি পেতে দিতে হচ্ছে ৮৫ হাজার টাকা। এবার হাটে ঢাক ও ঢাকি দুই–ই কম। এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে এবার দলপ্রধানেরা বেশি টাকা নিচ্ছেন।

পূজারি কৃষ্ণ চন্দ্রের অভিযোগের বিপরীতে ঢাকিদলের প্রধান সন্তোষ চন্দ্র বলেন, বাজারে সবকিছুর দাম চড়া। ঢাকিদলের মূল্য কম হলে পেট চলবে না। বাজার দর অনুযায়ী তাদের মূল্য কিছুটা বেড়েছে।

নরসিংদী থেকে হাটে আসা তিন সদস্যের ঢাকিদলের প্রধান সত্যেন্দ্র চন্দ্র দাস। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলা সদরের একটি মণ্ডপের জন্য ৩৫ হাজার টাকায় তিনি চুক্তিবদ্ধ হন। পূজারি সুমন কুমার বলেন, ‘গত বছর ২৫ হাজার টাকায় দল পেয়েছি। এবার লাগল ১০ হাজার বেশি।’ হাটে ঢাকির সংখ্যা কম থাকায় মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে বলে তাঁর মন্তব্য।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর ঢাকের হাটের ঐতিহ্য ৪০০ বছরের পুরোনো
ছবি: তাফসিলুল আজিজ

শনিবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত হাটে অবস্থান করে দেখা যায়, হাটে ঢাকিদলের সংখ্যা কম। ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাঁরা অবস্থান করছেন। চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আশায় কেউ বসে আছেন। আবার কেউ নেচে নেচে বাজনা বাজিয়ে পূজারির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন।

হাট পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এবার দুই শতাধিক ঢাকিদল এসেছে। শনিবার দুপুর পর্যন্ত সময়ে ২৪টি দল চুক্তিবদ্ধ হতে পেরেছে। আগের দিনও অনেকে চুক্তিবদ্ধ হয়ে চলে গেছে। প্রতিবারের মতো এবারও হাট বসে পুরাতন বাজারে।

জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তাঁর রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। কটিয়াদীর চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। একবার রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা ঢাকিদের সন্ধান করতে ঢাকার বিক্রমপুর পরগনার (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান। সে সময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকিদল পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাটে সমবেত হন। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নেন এবং পুরস্কৃত করেন। সেই থেকে যাত্রাঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু।

পরে হাট স্থানান্তরিত হয় পুরানবাজারে। এখনো হাট বসে সেখানে। নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ ও হবিগঞ্জ থেকে হাটে ঢাকিদল আসে বেশি। শুরুর রীতি অনুযায়ী এখনো হাটে ঢাকিরা পূজারির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সমবেতভাবে বাজনা বাজান। বাজনার যে দলের যত মুনশিয়ানা, পূজারির কাছে কদর তত বেশি। এবার হাট বসেছে শুক্রবার থেকে। রোববার ছিল শেষ দিন। প্রযুক্তির উৎকর্ষ হাটের ঐতিহ্যে বড় আঘাত হেনেছে বলে আয়োজকরা মনে করেন।

ঢাকিদের দেখাশোনা ও নিরাপত্তার প্রয়োজনে আছে একটি কমিটি। কমিটির অন্যতম সদস্য জিৎ সাহা। তিনি বলেন, এবারও অনেক ঢাকি এসেছেন। তবে চাহিদার বিপরীতে মনে হচ্ছে কম। ফলে ঢাকিরা চাহিদামতো মূল্য পাচ্ছেন।

কটিয়াদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাইদুল ইসলাম হাট পরিদর্শন করেছেন। ঢাকিদের নিরাপত্তায় নিয়েছেন কিছু পদক্ষেপ। তিনি বলেন, এবার সবকিছু ঠিক ছিল। কারও কোনো অভিযোগ নেই।