চায়ের কাপেই ‘মেরুদণ্ড অকেজো’ শিপনের এগিয়ে চলা
হুইলচেয়ারে বসে সারা দিন চা বানান মো. শিপন। আড্ডায় মুখর তাঁর ছোট্ট দোকানটিতে প্রতিদিন ভিড় করেন শত শত মানুষ। চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার দাশের বাজারে থাকা এই দোকান যেন শুধু চা বিক্রির জায়গা নয়—এটি একজন অদম্য মানুষের লড়াইয়ের স্মারক।
এখন থেকে ২০ বছর আগে ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে শিপনের জীবনে নেমে আসে কালো ছায়া। তাঁর মেরুদণ্ডে ধরা পড়ে টিউমার। অস্ত্রোপচারের পর শারীরিক অবস্থা আরও জটিল হয়। মেরুদণ্ড একেবারেই অকেজো হয়ে যায়। চলাফেরা করতে হয় হুইলচেয়ারে।
তবে এই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থামিয়ে রাখতে পারেনি শিপনকে। ঢাকার মিরপুরে দোকান দিয়ে চা বিক্রি শুরু করেছিলেন, কিন্তু একপর্যায়ে সরকারি অভিযানে দোকানটি ভেঙে ফেলা হয়। এরপর ২০১৩ সালে ফিরে আসেন গ্রামের বাড়ি—চাঁদপুরের লবাইরকান্দি গ্রামে। কয়েক বছর বেকার ছিলেন, আত্মবিশ্বাস হারাননি। এ বছরের শুরুতে ধারকর্জ করে বাড়ির পাশে দাশের বাজারে নতুন করে দোকান দেন। ৮০০ টাকা ভাড়ায় শুরু হওয়া সেই দোকানে এখন প্রতিদিন বিক্রি হয় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কাপ চা।
দুধ চা, রং চা, মসলার চা—যাঁর যা পছন্দ, শিপনের দোকানে তা মিলবে। শুধু স্বাদেই নয়, তাঁর চায়ের আলাদা খ্যাতি আছে যত্ন ও আন্তরিকতার জন্য। অনেকেই বলেন, তাঁর হাতে তৈরি চা যেন অন্য রকম। দূরের গ্রাম থেকেও অনেকে আসেন তাঁর চা খেতে। দোকানজুড়ে থাকে গরম চায়ের ধোঁয়া, গল্প আর প্রাণের স্পন্দন।
শিপনের বাবা একজন কৃষক। সংসারে অভাব ছিল বরাবরই। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে লেখাপড়া ছাড়তে হয় তাঁকে। এরপর জীবনের সংগ্রামে নেমে পড়েন। শিপনের কথায়, ‘কারও সাহায্য-ভিক্ষা চাই না, কাজ কইরা সম্মানের লগে বাঁচতে চাই। শরীরের মেরুদণ্ড অকেজো থাকলেও আমার মনের শক্তি-জোর তো অকেজো অয় নাই। যত দিন বাঁইচা থাহুম, কাম কইরাই খামু।’
শিপনের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, নানা বয়সী মানুষ চা খেতে এসেছেন। কেউ দুধ চা, কেউ মসলা চা নিচ্ছেন। সঙ্গে আছে বিস্কুট, কলা, ছোলা, বাটার বনসহ নানা খাবার। সরগরম আড্ডায় ভরে থাকে দোকানটি। চায়ের কাপের আড়ালে একজন মানুষের সংগ্রাম, আত্মমর্যাদা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি চোখে পড়ে স্পষ্টভাবে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, শিপন এক অনন্য উদাহরণ। আজকাল সুস্থ মানুষেরাও কাজ করতে চান না, সেখানে শিপনের মতো একজন প্রতিবন্ধী মানুষ প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিজ হাতে চা বানিয়ে সংসার চালাচ্ছেন—এটা নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণার।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদা কুলসুম মনি বলেন, ‘শারীরিক এত বড় সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তিনি যেভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তাঁকে সহায়তার জন্য আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি।’