মৃত্যুর পরও স্বজনদের পাশে পাচ্ছেন না জরিমন
স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ৪ দিন পর ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা জানিয়েছিলেন, তাঁর নাম জরিমন। বাড়ির পাশে আমবাগানে নিয়ে বস্তায় ভরে তাঁকে ফেলে দিয়ে গেছেন ছেলেমেয়ে। বাড়ির ঠিকানা বলেননি। অনেক বোঝানোর পর কেবল ছেলের নামটি বলেছিলেন, মামুন। বাড়ির কথা জানতে চাইলে রেগে গিয়ে জরিমন বলেছিলেন, ‘বাড়ি যাব না। মরার আগপর্যন্ত হাসপাতালে থাকব, নয়তো তোরা আমাকে নিয়ে যা।’
মাসখানেকের মাথায় গতকাল শুক্রবার ভোরে দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে জরিমনের। কিন্তু দাফনের ব্যবস্থা হয়নি। ময়নাতদন্ত শেষে মর্গে লাশ রাখা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বজনদের কাউকে না পেলে বেওয়ারিশ হিসেবে তাঁর লাশ দাফন করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
জরিমনকে উদ্ধার ও হাসপাতালে ভর্তির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দিনাজপুর জাগ্রত সমাজকল্যাণ সংস্থার পরিচালক আফসানা আফরোজ। তিনি বলেন, মাসখানেক আগে বস্তাবন্দী করে হাসপাতালের বারান্দায় ফেলে যাওয়া হয়েছিল জরিমনকে। শীর্ণকায় শরীরের চামড়া লেপ্টে ছিল হাড়ের মধ্যে। উষ্কখুষ্ক মাথার চুল। কথা বলতে পারছিলেন না। গোঙাচ্ছিলেন শুধু। এই কদিন হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা হয়েছে। কিছুটা সুস্থও হয়ে উঠেছিলেন। গত শুক্রবার ভোরের কোনো একসময় তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
আফসানা বলেন, যেহেতু স্বজনেরা কেউ এলেন না, তাই নিজেরাই বৃদ্ধার দাফন সম্পন্ন করতে চান। পুলিশের কাছে মৌখিকভাবে এ আবেদনও জানিয়েছেন তাঁরা।
স্বেচ্ছাসেবী ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ৪ ডিসেম্বর সকালে দিনাজপুরকেন্দ্রিক একটি ফেসবুক গ্রুপে হযরত আলী নামের এক ব্যক্তি একটি ছবি দিয়ে লেখেন, ‘এই বৃদ্ধ মহিলাকে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সির বাইরে করিডরে তাঁর ছেলে ফেলে রেখে গেছেন। মাছিও তাড়াতে পারছেন না। কথাও বলতে পারছেন না।’ বিষয়টি আফসানা আফরোজকেও মুঠোফোনে জানান তিনি।
করোনাকালে মানসিক ভারসাম্যহীন দুস্থ ও অসহায় মানুষের সেবা দেওয়ার কাজ করে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন আফসানা। তিনি হাসপাতালে ছুটে যান। তবে এদিক-সেদিক খুঁজে কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। হাসপাতালের উত্তর-পশ্চিম কোণে প্রাচীর ঘেঁষে গোঙানির শব্দ পেয়ে ওই দিন সন্ধ্যায় জরিমনকে উদ্ধার করেন।
পরে সংগঠনের সদস্য ও হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক আবদুস সালামের মাধ্যমে তাঁকে মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করা হয়। আবদুস সালাম, হাসপাতালের আয়া মুন্নি ও প্রিয়তী এবং সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকের তত্ত্বাবধানে কিছুটা সেরে উঠছিলেন জরিমন।
হাসপাতালের ইনডোর চিকিৎসা কর্মকর্তা একরাম হোসেন বলেন, অপুষ্টিজনিত কারণে ওই বৃদ্ধা রক্তশূন্যতায় ভুগছিলেন। শরীরের ওজন কম ছিল। এ ছাড়া কিডনির সমস্যাও ছিল। প্রথম দিন যখন ভর্তি হন, তখন কথা বলার মতো শক্তি পাচ্ছিলেন না। কিছুটা সুস্থও হয়েছিলেন।
সন্তানদের কাছ থেকে মা-বাবার ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে ‘মাতা-পিতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তানকে তাঁর মা-বাবার ভরণপোষণ (খাওয়াদাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা, বসবাস) নিশ্চিত করতে হবে। যদি কোনো সন্তান এই আইন লঙ্ঘন করে, তাদের এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ডের বিধান ও রাখা হয়েছে।
জাগ্রত সমাজকল্যাণ সংস্থার পরিচালক আফসানা আফরোজ বলেন, সম্প্রতি মা-বাবার প্রতি নির্যাতন বেড়েছে। করোনাকাল থেকে গত দুই বছরে এমন ২০ জন মানুষকে সেবা দিয়েছেন। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাতজনকে স্বজনদের কাছে ফেরতও পাঠিয়েছেন। এখনো পাঁচজন তাঁদের তত্ত্বাবধানে আছেন। তিনি বলেন, মা-বাবার ভরণপোষণ নিয়ে আইনের বিষয়টি আরও প্রচারণা দরকার। তাহলে মানুষ জানবে, সচেতন হবে এবং মা-বাবার প্রতি সন্তানদের অবহেলা ও নির্যাতন কমবে।
উদ্ধার হওয়ার পর থেকেই জরিমনের বাড়ির ঠিকানা পেতে নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শামীম হক। তিনি আজ শনিবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওয়ারিশ কিংবা স্বজনদের না পাওয়া গেলে দাফনের জন্য আঞ্জুমানে মুফিদুলের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।