তিন দিনেও বরিশাল বিভাগে বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি সচল হয়নি

গাছ উপড়ে পল্লী বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে সড়কের ওপর পড়ে রয়েছে। বুধবার সকালে পটুয়াখালীর জৈনকাঠি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

ঘূর্ণিঝড় রিমালের পর তিন দিন পেরিয়ে গেলেও বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল হয়নি। বিভাগের চারটি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় ১৭ লাখ ৬৭ হাজার এবং পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার (ওজোপাডিকো) ৩ লাখ ৪০ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। এর মধ্যে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রায় ৮০ ভাগ গ্রাহক এখনো বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট পরিষেবাও ব্যাহত হচ্ছে।

বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার চর বোয়ালিয়া গ্রামের বাসিন্দা দুলাল হাওলাদার বলেন, ‘বিদ্যুৎ ছাড়া মানুষ তো এখন আর এক সেকেন্ড চলতে পারে না। ফ্রিজ বন্ধ, ফ্যান ঘোরে না, অসহনীয় গরম। এমন অবস্থায় চার দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। রাতে ঘুমাতে পারি না। এত বড় ঝড় গেল, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করব যে মোবাইলেও কল যায় না। টিভি নেই, ইন্টারনেটও নেই। আমরা একেবারে অন্ধকারে আছি। জীবন এত দুর্বিষহ যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।’

বরিশাল-পটুয়াখালীর মহাসড়কের পূর্ব দিকে দুই কিলোমিটার দূরে কুলাকলী নদীতীরের এই গ্রামে যেতে চোখে পড়ে পল্লী বিদ্যুতের সরবরাহ লাইনের ওপর অসংখ্য গাছ পড়ে আছে। অপসারণে কাজ করছেন এক দল শ্রমিক। সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত পল্লী বিদ্যুতের লাইনম্যান সুভাষ দাশ বলেন, ‘ঝড়ের পর মঙ্গলবার ভোরে আমরা বাকেরগঞ্জ উপজেলা সদরের লাইন সচল করতে পেরেছি। বাকি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল করা যায়নি। যে অবস্থা, তাতে সচল করতে অন্তত ২০ দিন লেগে যাবে। এই উপজেলায় ৭০ হাজার গ্রাহক রয়েছে।’

ওজোপাডিকো ও পল্লী বিদ্যুৎ সূত্র জানায়, গত রোববার রাতে রিমালের তাণ্ডব শুরুর পর বিভাগের সর্বত্র বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বুধবার পর্যন্ত ওজোপাডিকোর অন্তত তিন লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ–সংযোগ আবার চালু করা গেছে। বাকি ৪০ হাজার গ্রাহকের বিদ্যুৎ–সুবিধা নিশ্চিত করা যায়নি। বিভাগে চারটি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় ১৭ লাখ ৬৭ হাজার গ্রাহক রয়েছেন, এর বেশির ভাগই এখন অন্ধকারে।

ওজোপাডিকো বরিশাল অঞ্চলের পরিচালন ও সংরক্ষণ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবদুল মজিদ গতকাল বুধবার দুপুরে বলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনে অসংখ্য গাছ ভেঙে পড়ে আছে। খুঁটি ও সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব মেরামত ও গাছ অপসারণে সময় লাগছে। বরিশাল নগরে ও পিরোজপুর শহরের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ চালু হয়ে গেছে। কিন্তু ঝালকাঠি শহরে এখনো চালু হয়নি। আর নলছিটিতে হাজার পাঁচেক গ্রাহক পেয়েছেন, এখনো ৯ হাজার গ্রাহক পাননি। সেখানে আটটি পুল ভেঙেছে। এ জন্য সময় লাগছে।

বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর আওতায় ৩ লাখ ২০ হাজার ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর আওতায় ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৬ গ্রাহক রয়েছেন। আর পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় ৬ লাখ ৭০ হাজার ও পিরোজপুরে আছেন ৫ লাখ ৭ হাজার ৪৪১ জন গ্রাহক। এসব গ্রাহকের অধিকাংশই এখন অন্ধকারে রয়েছেন।

বরগুনা সদর উপজেলার হাজারবিঘা গ্রামের নুরুল হক বলেন, বুধবার পর্যন্ত বিদ্যুৎ আসেনি। জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এ এলাকা পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় রয়েছে। জেলার পাথরঘাটা, বামনা, বেতাগী উপজেলায়ও বিদ্যুৎ নেই। এই তিন উপজেলা পিরোজপুর বিদ্যুৎ সমিতির আওতায়।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে গাছ উপড়ে পড়ে বিদ্যুৎ লাইন ছিঁড়ে ও খুঁটি ভেঙে ঝালকাঠিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ। শহরের জেলা শিল্পকলা একাডেমির সামনে
প্রথম আলো

পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক তুষার কান্তি মণ্ডল গতকাল বলেন, পটুয়াখালী সমিতির আওতায় ৬ লাখ ৭০ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। এর মধ্যে বুধবার পর্যন্ত ৩ লাখ ৮৫ হাজার গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল করা গেছে। বাকিদের যায়নি।

পিরোজপুর, বরিশাল-২ সমিতির মহাব্যবস্থাপকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা কেউই ফোন ধরেননি। তাই এই তিন সমিতির আওতায় কত গ্রাহক এখনো বিদ্যুৎবিহীন রয়েছেন, এর তথ্য পাওয়া যায়নি। বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ১–এর মহাব্যবস্থাপক মো. হুমায়ুন কবির বলেন, সমিতির আওতায় ৩ লাখ ২০ হাজার গ্রাহক আছেন। এর মধ্যে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাহক বিদ্যুৎ পেয়েছেন। বাকিরা পাননি। বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনে অসংখ্য গাছ উপড়ে পড়ে আছে। সরবরাহ ঠিক করতে দু-তিন দিন লেগে যেতে পারে।

টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোর সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে বিদ্যুৎ-বিভ্রাটে ১০ হাজারের বেশি মোবাইল টাওয়ার বা বেজ ট্রান্সমিটার স্টেশন (বিটিএস) সেবা দিতে পারছে না। বিটিএস রেডিও সংকেতের মাধ্যমে মোবাইল ডিভাইসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কল ও ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে থাকে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়েছে দক্ষিণের জেলাগুলোর লাখ লাখ মানুষের মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর। বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, ভোলা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ আরও কয়েকটি জেলার অধিকাংশ মানুষ টেলিযোগাযোগসেবা বিঘ্ন ঘটছে।

টেলিকম কোম্পানির কর্মকর্তাদের মতে, একটি বিটিএসের জন্য স্ট্যান্ডার্ড ব্যাটারি ব্যাকআপের সময়কাল সাধারণত চার থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত, যা বিদ্যুৎ প্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে। স্বল্প থেকে মাঝারি সময়ের বিদ্যুৎ-বিভ্রাট হলেও এই ব্যাকআপের মাধ্যমে টাওয়ার চালু থাকে। কিন্তু দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন থাকায় টেলিযোগাযোগ একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।