বৈশাখী মেলা ঘিরে যত আশা 

বৈশাখী মেলার অপেক্ষায় ছিল এ পালপাড়ার ৩২টি পরিবার। সেখানে এখন মাত্র অল্প কয়েকটি পরিবার বাপ-দাদার এই পেশা আঁকড়ে ধরে আছে।

বাড়ির উঠানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে মাটির বাহারি পণ্য। এসব পণ্য আজ পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন মেলায় নিয়ে বিক্রি করা হবে। কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার পালপাড়ায় গতকাল
ছবি: প্রথম আলো

পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য নমিতা বর্মণও (৮০) এখন খুব ব্যস্ত সময় পার করছেন। সদ্য তৈরি মাটির তৈজসপত্র দেখেশুনে গুছিয়ে রাখছেন। আজ শুক্রবার পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে বসবে মেলা। সেসব মেলায় এসব তৈজসপত্র বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়া হবে। বছরের এই সময়টাতেই মাটির জিনিসপত্র বেশি বিক্রি হয়। তাই পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নমিতাও নেমে পড়েছেন কাজে। 

গতকাল বৃহস্পতিবার কিশোরগঞ্জের হাওর অধ্যুষিত নিকলী উপজেলার সদর ইউনিয়নের পালপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির ছোট থেকে বড়—সবাই ব্যস্ত। এলাকার লোকজন বলেন, বৈশাখী মেলার অপেক্ষায় ছিল এ পালপাড়ার ৩২টি পরিবার। অভাবের কারণে নানা টানাপোড়েনের কাটছে তাঁদের জীবন। অনেকে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। কয়েক দশক আগে এ এলাকায় হাজারো পরিবার এ পেশায় জড়িত ছিল। সেখানে এখন মাত্র অল্প কয়েকটি পরিবার বাপ-দাদার এই পেশাটিকে আঁকড়ে ধরে আছে।

নমিতা বর্মণ বলেন, বর্তমানে মাটির অভাব আছে। পাশাপাশি সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব খেলনা ও গৃহস্থালির তৈজসপত্র তৈরি করতে অনেক সমস্যা পোহাচ্ছেন তাঁরা। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এ পেশায় অনাগ্রহ প্রকাশ করছে। এ কারণেই পেশা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।

গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, মাটি দিয়ে বিশেষ কায়দায় তৈরি বাহারি তৈজসপত্রে রং করছেন গ্রামের রঞ্জিত পাল। তাঁকে সহযোগিতা করছেন তাঁর ভাই অঞ্জন পাল। পরিবারের সদস্যরা কাদামাটি দিয়ে সম্প্রতি সব বাহারি পণ্য তৈরি করেছেন। এরপর এসব পণ্য রোদে শুকিয়ে আগুনে পোড়ানো হয়। রং করা প্রায় শেষের দিকে। এরপর প্যাকেট করে গুছিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে মেলায়। 

পালপাড়া ঘুরে দেখা যায়, মৃৎশিল্পীরা প্লেট, গ্লাস, মগ, জগ, লবণ বাটি, সানকি (বাসন), কাপ-পিরিচ ও তরকারির বাটি তৈরি করেছেন। আরও আছে, হাতি, ঘোড়া, গরু, হরিণ, সিংহ, বাঘ, ভালুক, জেব্রা, হাঁস, মুরগি। ছোট শিশুদের জন্য আরও আছে খেলনা হাঁড়ি-পাতিল ও বিভিন্ন ধরনের চুলা। নতুন নকশার কয়েলদানি, মোমদানি, ফুলদানি ও বাহারি রঙের মাটির ব্যাংক তৈরি করা হয়েছে। 

পালপাড়ার শিল্পীরা বলেন, সবার পছন্দমতো তাঁরা মাটির পণ্য গড়ার চেষ্টা করেছেন। নকশাতেও এনেছেন বৈচিত্র্য। যাঁরা দূরের মেলায় যাবেন, তাঁরা আগেই রওনা দিয়ে দিয়েছেন। আশা করছেন বিক্রি ভালো হবে। সামনে ঈদ। ঈদেও অনেকে নতুন ও ঘর সাজানোর জিনিস কেনেন। ফলে এবার ভালো বিক্রি হওয়ার আশা রয়েছে তাঁদের। 

রঞ্জিত পাল বলেন, এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত তাঁরা। প্লাস্টিকের জিনিসের ভিড়ে মাটির তৈরি এসব হাঁড়ি-পাতিল, কলসির ব্যবহার কমে যাওয়ায় তাঁদের মতো মৃৎশিল্পীরা অন্য কাজে ঝুঁকে পড়ছেন। বর্তমানে হাতে গোনা কিছু এলাকায় মাটির জিনিস তৈরি হয়। তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন কখন আসবে বৈশাখ, কখন আসবে মেলা। এ সময়ে যা লাভ হয়, তা দিয়েই চলে সংসার। ঊর্ধ্বগতির এ বাজারে ধারদেনা করে অনেকটা দিশেহারা তাঁরা। উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভও কম হচ্ছে। 

স্থানীয় বাসিন্দা শামীম আল মামুন বলেন, মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় এ পেশা কোনোমতে টিকে আছে। এ ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহযোগিতা করা উচিত। 

এ ব্যাপারে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, কিশোরগঞ্জ জেলায় মোট ৫৭০টি মৃৎশিল্প পরিবারের প্রায় দুই হাজারের বেশি লোক এ শিল্পের সঙ্গে এখনো জড়িত রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে মৃৎশিল্পীদের প্রশিক্ষণসহ নানা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। 

নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. শাকিলা পারভীন বলেন, নিকলী পাল পাড়ার মৃৎশিল্পীদের সম্বন্ধে তিনি খোঁজখবর নেবেন। তাই এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে উপজেলা প্রশাসন সহযোগিতা করবে।