হাজারো মানুষকে রোজ ইফতার করান

রমজান মাসজুড়ে এমন গণ–ইফতারের আয়োজন করা হয় সিলেট নগরের লামাবাজার এলাকায়ছবি: আনিস মাহমুদ

সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। লাইন ধরে বসে আছে সারি সারি মানুষ। তাঁদের কেউ রিকশাচালক, কেউ ঠেলাচালক, কেউবা পথচলতি মানুষ। সবার সামনে প্লেটভর্তি খাবার। ইফতারের জন্য অপেক্ষা সবার। সিলেট নগরের লামাবাজারে জেলা স্টেডিয়াম লাগোয়া মোহাম্মদ আলী জিমনেসিয়ামে গেলে এমন দৃশ্য প্রতিদিনই চোখে পড়বে।
প্রায় দেড় হাজার মানুষের এই ইফতারে শামিল হতে কোনো টাকা লাগে না। বিনা মূল্যে রোজাদাররা প্লেটে পান আখনি, খেজুর, জিলাপি, পেঁয়াজু, ছানা, লেবু, শরবত আর আধা লিটারের পানির বোতল।
বিনা মূল্যে এমন গণ–ইফতারের আয়োজন করেন সিলেটের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহি উদ্দিন আহমদ ওরফে সেলিম। তিনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কার্যনির্বাহী সদস্য। গত বছর থেকে রমজান মাসজুড়ে হাজারো মানুষকে বিনা মূল্যে ইফতারি খাওয়াচ্ছেন।

শুধু কি ইফতার! অসচ্ছল ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে নিত্যপণ্যের বিশেষ স্লিপও বিতরণ করেন মাহি উদ্দিন। ১৬ হাজার ৪ টাকা ও ৯ হাজার ৯০ টাকা মূল্যের দুই ধরনের স্লিপ আছে। এসব স্লিপ দেখিয়ে সিলেট নগরের নির্দিষ্ট কিছু দোকান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করতে পারেন তাঁরা।
‘মাহা’ নামে মাহি উদ্দিন আহমদের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে কাপড়, প্রসাধনসামগ্রী ও সুগন্ধি বিক্রি হয়। কাতারেও তাঁর সুগন্ধির তিনটি প্রতিষ্ঠান আছে। সিলেটের সেরা রেমিট্যান্সধারী হিসেবে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে ২০২১ সালে সিআইপির (বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি) মর্যাদা পান। তিনি প্রতি মাসে শিক্ষাবৃত্তি ও খেলাধুলা আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতাসহ অসহায়দের আর্থিক সহযোগিতাও দেন।

ইফতারের প্রস্তুতি নিজেও তদারক করেন মাহি উদ্দিন আহমদ
ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি এক বিকেলে সরেজমিনে জিমনেসিয়াম এলাকায় গেলে মেঝেতে পাতা কার্পেট আর চাদরের ওপর বসা নানা বয়সী মানুষ দেখা গেল। তাঁদের সবার সামনে ইফতারির প্লেট সাজানো। আজান পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই একসঙ্গে ইফতার শুরু করলেন।
পঞ্চাশোর্ধ্ব শ্রমজীবী মালেক মিয়া জানান, প্রতিদিন কাজ শেষে তিনি এখানে ইফতার সারেন। ইফতারির মান ভালো। আফতাব মিয়া নামের এক প্রতিবন্ধী যুবক বলেন, গরিব ও অসহায় মানুষের জন্য গণ–ইফতারের এমন আয়োজন ভালো একটি উদ্যোগ। প্রতিদিন রোজাদারের ভিড় বাড়ছে।
জেলা ক্রীড়া সংস্থা জানিয়েছে, রোজকার ইফতারি তৈরি করতে এক মাসের জন্য বাবুর্চি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় রোজা থেকে শুরু হওয়া এ আয়োজন চলবে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত। ১৬ সদস্যের একটি দল বাজার ও রান্না থেকে ইফতারি পরিবেশনসহ যাবতীয় কাজ করে। বিভিন্ন পদের ইফতারির সঙ্গে একেক দিন একেক রকমের আখনি থাকে। মোরগ, খাসি ও গরু—এই তিন রকমের আখনিই থাকে। প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৪০০ মানুষের জন্য আয়োজন রাখা হয়। এতে দৈনিক আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ হয়।

মাহি উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা সময়ে আরব দেশে ছিলাম। সেখানে এমন আয়োজন দেখতাম। এতে শরিক হয়ে পথচলতি মানুষ থেকে শুরু করে নানাজন এক কাতারে বসে ইফতার সারতেন। মূলত সে অনুপ্রেরণাতেই গত বছর থেকে নিজ শহরে এমন আয়োজন শুরু করেছি। এমন সুন্দর একটা দৃশ্য প্রতিদিন দেখি, আর মুগ্ধ হই।’
মাহি উদ্দিনের উদ্যোগে এত মানুষের ইফতার নতুন হলেও দুই ধরনের প্যাকেজের পণ্য উপহার দেওয়ার রীতিটা বছর কয়েক আগের। ২০২০ সাল থেকে প্রতি রমজান মাসে এই উপহার দেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার মানুষকে পণ্যতালিকার প্যাকেজ উপহার দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই পেয়েছেন ১৬ হাজার ৪ টাকার প্যাকেজ। রমজান মাসজুড়ে এ কার্যক্রম চলবে।

১৬ হাজার ৪ টাকার পণ্যতালিকার প্যাকেজে রয়েছে ৫০ কেজি ওজনের ১ বস্তা মালা চাল, ২০ কেজি আলু, ২০ কেজি পেঁয়াজ, ৮ লিটার রূপচাঁদা সয়াবিন তেলসহ চানা, মসুর ডাল, চিনি, লবণ, রসুন, খেজুর, গুঁড়া দুধ, চা-পাতা, আদা, গুঁড়া মরিচ, গুঁড়া হলুদ, ধনিয়া গুঁড়া, ট্যাং, সেমাই ও লাক্স সাবান। আর ৯ হাজার ৯০ টাকার পণ্যতালিকার প্যাকেজে রয়েছে ২৫ কেজি ওজনের ১ বস্তা মালা চালসহ আলু, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, ছানা, মসুর ডাল, চিনি, লবণ, রসুন, খেজুর, গুঁড়া দুধ, চা-পাতা, আদা, গুঁড়া মরিচ, গুঁড়া হলুদ, গুঁড়া ধনিয়া, ট্যাং, সেমাই ও লাক্স সাবান।
মাহি উদ্দিন আহমদ বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলো যাঁদের দেওয়া হচ্ছে, কারও নামই কোথাও প্রকাশ করা হচ্ছে না। এটা আমরা প্রচারও করতে চাই না। তবে স্বচ্ছতার স্বার্থে সবার নাম-ঠিকানা, মুঠোফোন নম্বর রাখা হয়। মূলত পবিত্র রমজানের আনন্দ সবাই মিলে ভাগাভাগি করতেই এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মাহি উদ্দিন আহমদের গণইফতারের আয়োজনটি দারুণ উদ্যোগ। এ ছাড়া স্লিপ দিয়ে যেভাবে তিনি বিনামূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী দরিদ্র ও বিপাকে পড়া মানুষজনদের দিচ্ছেন, সেটাও প্রশংসনীয়। তাঁর মতো সব বিত্তবান যদি এভাবে এগিয়ে আসতেন, তাহলে আমাদের সমাজ আরও আলোকিত হতো।