চেষ্টা করেও যমজ ভাইকে বাঁচাতে পারেনি ছোট্ট নাঈম

এক স্বজনের পাশে বসে ভাই হারানোর বর্ণনা দেয় শিশু নাঈম। শুক্রবার ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের চন্ডীপুর গুঞ্জরগড় গ্রামেছবি: প্রথম আলো

কাওসার ও নাঈম যমজ ভাই। জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়ালেখা একসঙ্গে। চাচাতো ভাই রাজুকে সঙ্গে নিয়ে তারা বাড়ির পাশে পুকুরপাড়ে গাছ থেকে বরই পাড়তে গিয়েছিল। বরইগাছে ঝাঁকুনি দিচ্ছিল রাজু। কাউসার ও নাঈম বরই কুড়াচ্ছিল। একপর্যায়ে পা পিছলে পুকুরে পড়ে যায় কাউসার। তাকে বাঁচাতে পুকুরে ঝাঁপ দেয় রাজু। কিন্তু দুজনই পুকুরের পানিতে তলিয়ে যায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় নাঈম দৌড়ে মাকে ডেকে আনলেও ভাইদের আর বাঁচাতে পারেনি।

গতকাল বৃহস্পতিবার পুকুরে ডুবে নাঈমের যমজ ভাই কাউসার ও চাচাতো ভাই রাজু মারা গেছে। তাদের বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের চণ্ডীপুর গুঞ্জরগড় গ্রামে। বাড়িতে নবাগত কাউকে দেখলেই মর্মান্তিক ওই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে ছোট্ট নাঈম। আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্থানীয় কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়। কাওসার ও রাজু সম্পর্কে একে-অপরের চাচাতো ভাই।

আজ বেলা পৌনে ১১টার দিকে নাঈমদের বাড়িতে পৌঁছাতেই কান্নার শব্দ ভেসে এল। বাড়ির উঠানে প্রতিবেশীদের ভিড়। কেউই দুই শিশুর মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। ছেলের শোকে কাওসারের মা হাসিনা বেগমের মাতম থামছেই না। ‘চেখের সামনে ছেলে দুইটা ডুবে গেল, বাঁচাতে পারলাম না,’ বলতে বলতে মূর্ছা যান তিনি।

কাওসারের বাবা ইদ্রিস আলী জানালেন, তাঁর চার ছেলেমেয়ে। কাওসার ও নাঈম যমজ। একসঙ্গে চলাফেরা করত। তাঁর ছোট ভাইয়ের ছেলে রাজুকে নিয়ে গতকাল দুপুরে বাড়ির পাশে বরই পাড়তে গিয়েছিল। সেখানেই কাওসার ও রাজু পুকুরে ডুবে মারা যায়। তাদের ডুবে যাওয়া দেখে নাঈম তার মাকে ডেকে নিয়ে যায়। মাকে ডেকে নিয়ে গেলেও ওদের বাঁচানো যায়নি। নাঈম এখন একা হয়ে গেল।

উঠানের এক কোণে বসে মর্মান্তিক ওই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিল নাঈম। সে জানায়, কাওসার ও রাজুকে পুকুরে তলিয়ে যেতে দেখে সে দৌড়ে এসে মাকে জানায়। মাকে নিয়ে পুকুরপাড়ে ফিরে এসে দেখে, দুজনই তলিয়ে গেছে। নাঈমের কথার ফাঁকে ইদ্রিস আলী বললেন, এরপর গ্রামবাসী খোঁজাখুঁজি করলেও ছেলে দুইটার সন্ধান পাননি। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে পুকুরের গর্ত থেকে তাদের উদ্ধার করে। একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন ইদ্রিস।

যে পুকুরের পানিতে ডুবে কাউসার ও রাজু মারা যায়, স্বজনেরা সেটি দেখাচ্ছিলেন। আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের চন্ডীপুর গুঞ্জরগড় গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

নিজেকে সামলে নিয়ে ইদ্রিস আলী বলেন, ‘যমজ দুই ভাই জোব্বা বানানোর বায়না ধরেছিল। সেই জোব্বা কাল (শনিবার) দরজির কাছ থেকে নিয়ে আসার কথা। জোব্বা তো বানানো হইল, কিন্তু পরতে পারল না।’

পড়ে আছে দুই জোড়া স্যান্ডেল
ওই পুকুরপাড়ে গিয়ে জনাদশেকের জটলা দেখা গেল। তাঁরা কাওসার ও রাজুর ডুবে যাওয়া নিয়ে আলোচনা করছিলেন। সেখানে রাজুর বাবা আবদুর রাজ্জাককেও পাওয়া গেল। তিনি বলেন, ‘রাজু আমার ছেলে হলেও বন্ধুর মতো ছিল। জন্মের পর রাজু অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওর বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। চিকিৎসা করানোর টাকাও ছিল না। মানুষের কাছে ধারদেনা করে চিকিৎসা করানোর পর সুস্থ হয়ে ওঠে। এর পর থেকে ওর প্রতি আমার টানটা একটু বেশি ছিল। গত সপ্তাহে রাজু ফোন দিয়ে বলে, “বাবা, ফুপুর বিয়ে। সবাই নতুন পাঞ্জাবি কিনবে। আমারও একটা চাই।” ছেলের আবদারে না করতে পারিনি। টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি।’

এখনো পুকুর পাড়ে কাওসার ও রাজুর দুই জোড়া স্যান্ডেল পড়ে আছে। আজ ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের চন্ডীপুর গুঞ্জরগড় গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

রাজ্জাক বলেন, ‘ছেলেকে ছেড়ে থাকতে মন মানছিল না। ঈদের আগে রাজুকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। গতকাল সকালে রাজুর সঙ্গে কথা বলতে বাড়িতে ফোন দিয়েছিলাম। আম্মা (রাজ্জাকের মা) বলেন, “রাজু প্রাইভেটে গেছে। ফিরলে ফোন দেব।” বাড়ি থেকে ফোন ঠিকই দিয়েছিল। তবে তা রাজুর সঙ্গে কথা বলার জন্য নয়, ওর মারা যাওয়ার খবর জানাতে,’ বলতে বলতে কেঁদে ওঠেন রাজ্জাক।

ফেরার পথে পুকুরপাড়ে চোখ পড়তেই দুই জোড়া রাবারের স্যান্ডেল দেখা গেল। রাজু ও কাওসারের এক স্বজন জানালেন, স্যান্ডেলগুলো রেখে তারা বরই পাড়তে গিয়েছিল। সেগুলো এখনো সেখানে পড়ে আছে। স্থানীয় তরুণ ফারুক হোসেন জানালেন, পুকুরে ডুবে দুই ভাইয়ের মারা যাওয়া পুকুরে তেমন পানি নেই। সম্প্রতি পুকুরের মালিক শ্যালো মেশিন দিয়ে খননযন্ত্র বসিয়ে পুকুর থেকে বালু তুলেছেন। এতেই একটি গভীর গর্ত সৃষ্টি হয়। ওই গর্তের গভীরতা আনুমানিক ২৫ ফুট। পুকুরের ওই গর্তে পড়ে তারা মারা গেছে।

রাজ্জাকের চাচা মো. খলিল বললেন, পুকুরে মেশিন দিয়ে বালু তোলায় গর্তের কারণেই বাচ্চা দুটি মারা গেল। গর্তটি না থাকলে ঘটনা অন্য রকম হতে পারত। পুকুরের মালিককে গ্রামের সবাই গর্তটি ভরাট করতে বলেছেন। তিনি না করলে সবাই মিলে ভরাট করে দেবেন।

আরও পড়ুন