চট্টগ্রাম নগরের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজের মান ও ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নির্মাণকাজ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে। এসব প্রশ্ন তুলেছে খোদ গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি।
অভিযোগগুলো তদন্ত এবং নির্মাণকাজের গুণগত মান যাচাইয়ে একটি উপকমিটিও গঠন করেছে স্থায়ী কমিটি। গত ১০ জুন চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এম এ লতিফকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন বগুড়া-৫ আসনের সংসদ সদস্য মো. মজিবুর রহমান এবং সংরক্ষিত আসনের সদস্য পারভীন জামান।
উপকমিটির সদস্যরা প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে তিন দিনের সফরে আগামীকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে আসছেন। তাঁদের সঙ্গে থাকবেন স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ।
প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের পাশাপাশি প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সভা করবেন উপকমিটির সদস্যরা। এ ছাড়া চট্টগ্রামে নিজেদের মধ্যেও বৈঠক করবে কমিটি।
নগরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে যৌথভাবে কাজ করছে বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও চীনের র্যাঙ্কিন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছরের ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চ্যুয়ালি চট্টগ্রাম নগরের ‘মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী-সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ে’ এর উদ্বোধন করেছিলেন। যদিও উদ্বোধনের সাড়ে সাত মাস পার হলেও গাড়ি চলাচল শুরু হয়নি।
১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়ে নগরের লালখান বাজার থেকে শুরু হয়ে পতেঙ্গায় গিয়ে শেষ হয়েছে। এই এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন অংশে ১৫টি র্যাম্প (গাড়ি ওঠা-নামার পথ) রয়েছে। মূল অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ হলেও এখনো র্যাম্পের কাজ সম্পন্ন হয়নি।
স্থায়ী কমিটির গঠন করা উপকমিটির অন্যতম সদস্য ও সংসদ সদস্য মো. মজিবুর রহমান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী-সিডিএ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এক্সপ্রেসওয়ের পিলারে ফাটল; যেখানে-সেখানে র্যাম্প নির্মাণ; হুকুম দখল না করে জমি কেনা হয়েছে। আবার কাজের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া এই প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বেড়েছে। কেন এত টাকা বৃদ্ধি পেল? মূলত এসব বিষয়গুলো তদন্ত করার জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাঁরা পরিদর্শন করে অভিযোগগুলো তদন্ত করে দেখবেন। আর প্রতিবেদন দেবেন।
প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলাকালে গত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের চারটি পিলারে ফাটল ধরে। এক্সপ্রেসওয়ের লালখান বাজার অংশে অন্তত চারটি পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছিল। ওই সময় ফাটলের অংশ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল। পরে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে তা সংস্কার করে সিডিএ।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এবং সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শতভাগ গুণগত মান নিশ্চিত করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ করা হয়েছে।
সাত বছর আগে ২০১৭ সালের ১১ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে। এখন ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। খরচ বেড়েছে ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সংশোধিত প্রকল্প একনেকের সভায় অনুমোদিত হয়।
তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু কাজই শুরু করেছিল ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। পরে দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। তা–ও শেষ হয়েছে। কিন্তু এখনো প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। আরও এক বছর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।
প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, শুরুতে এটি নেওয়া হয়েছিল অনুমানের ভিত্তিতে ব্যয় প্রাক্কলন এবং তড়িঘড়ি করে। প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইও (ফিজিবিলিটি স্টাডি) ভালোভাবে করা হয়নি। ওই সময় যদি ডিপিপি ঠিকভাবে করা হতো, তাহলে তখনই ব্যয়ের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে যেত। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বিস্তারিত সম্ভাব্যতা যাচাই করতে গিয়ে নির্মাণকাজের ধরন ও নকশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। এ জন্য ব্যয় বেড়েছে।