সাগরকন্যা কুয়াকাটায় পর্যটকের আনাগোনা কম, হতাশ ব্যবসায়ীরা
সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য সবার কাছে পরিচিত নাম ‘সাগরকন্যা কুয়াকাটা’। সুযোগ পেলেই দূরদূরান্ত থেকে কুয়াকাটায় ছুটে আসেন ভ্রমণবিলাসী মানুষ। এবারও ঈদুল আজহার ১০ দিনের টানা ছুটিকে কেন্দ্র করে পর্যটকেরা আসতে শুরু করেছেন। তবে অন্যবারের তুলনায় সংখ্যায় তা কম।
পর্যটকদের আনাগোনা সেভাবে না থাকায় ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকত বলতে গেলে ফাঁকাই দেখা যায়। আজ রোববার বিকেল সাড়ে চারটার সময় শুধু সৈকতের জিরো পয়েন্ট–সংলগ্ন এলাকায় বেশ কিছু পর্যটককে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। জিরো পয়েন্টের সামনে থেকে সমুদ্রের নোনাপানিতে নেমে কেউ কেউ গোসলও করছিলেন। শামুক-ঝিনুকের দোকান, ডাব বিক্রেতা, চা-পানের দোকান, খাবার হোটেল—কোথাও ভিড় নেই। বিশেষ দিনেও কুয়াকাটার মতো আকর্ষণীয় একটি পর্যটনকেন্দ্র সাধারণত এমন ‘নীরব’ থাকে না বলে জানালেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
সৈকত এলাকায় চটপটি বিক্রি করেন আবদুল মজিদ। তিনি বলেন, ঈদের দিন বিকেলেও মানুষজন আসেন কুয়াকাটায়। কাছাকাছি এলাকা থেকে ঘুরতে আসা সেসব মানুষ ঘুরেফিরে রাতে যাঁর যাঁর গন্তব্যে চলে গেছেন। আজ ঈদের দ্বিতীয় দিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকেরা আসতে শুরু করেছেন। তবে গতবারের তুলনায় অনেক কম।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্নভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। প্রত্যাশা অনুযায়ী পর্যটক না আসায় হতাশা প্রকাশ করলেন কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোতালেব শরীফ। পর্যটক না থাকার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, আসলে দেশের অবস্থা, আর্থিক সংকট, কুয়াকাটা পর্যটনের নানাবিধ সমস্যায় পর্যটক কম আসবে বলে মনে হচ্ছে।
কুয়াকাটা সৈকতে বাণিজ্যিকভাবে ছবি তোলার কাজ করেন আমির হোসেন দূয়ারী। কুয়াকাটার পাঞ্জুপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। ১০ বছর ধরে তিনি ছবি তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, গত বছর কোরবানির ঈদের দ্বিতীয় দিন ২ হাজার ৫০০ টাকা আয় করেছিলেন। সেবার এক সপ্তাহে ২৬ হাজার টাকা আয় করেছেন। এবার সেভাবে পর্যটক না থাকায় আয়রোজগার খুব খারাপ। আজ সারা দিনে ১ হাজার ২০০ টাকা আয় হয়েছে।
কুয়াকাটায় ২২১ জন ফটোগ্রাফার বাণিজ্যিক ছবি তোলার কাজের সঙ্গে যুক্ত বলে তিনি জানান। আয়রোজগার কম থাকায় এরা সবাই অভাব-অনটনে পড়েছেন।
এদিকে কুয়াকাটা পর্যটনের সুনাম ও ঐতিহ্য ফেরাতে আজ বিকেল থেকে আগামী তিন দিন ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটা (টোয়াক) পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেছে। টোয়াকের একটি দল সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট রুমান ইমতিয়াজের নেতৃত্বে সৈকত এলাকাসহ কুয়াকাটার বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্পট পরিদর্শন করবেন। টোয়াকের পর্যবেক্ষক দলের সদস্যরা পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলে খোঁজখবর নেবেন। পর্যটকদের কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পেলে ট্যুরিস্ট পুলিশ, থানা–পুলিশ বা সেনা ক্যাম্পে জানিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবেন।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোতালেব শরীফ জানিয়েছেন, কুয়াকাটায় ১৭০টির মতো আবাসিক হোটেল-মোটেল রয়েছে। এসব হোটেল-মোটেলের কক্ষ বুকিং কেমন হয়েছে, তা ওভাবে বলা যাবে না। তবে প্রথম শ্রেণির ১৫-২০টি হোটেলের কোনোটা ৪০ শতাংশ আবার কোনোটাতে ৫০ শতাংশ কক্ষ বুকিং হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঈদের দীর্ঘ ছুটিকে সামনে রেখে পর্যটকদের জন্য আবাসিক হোটেল-রেস্তোরাঁ ধুয়েমুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। এ ছাড়া রাখাইন মহিলা মার্কেট, ঝিনুক মার্কেটের দোকানিরা বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসেছেন। সৈকতের মাছ ফ্রাইয়ের দোকানগুলোতে ব্যবসায়ীরা ইলিশ, কোরাল, লবস্টার, রুপচাঁদা, টুনা, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ জেলেদের কাছ থেকে কিনে রেখেছেন।
সৈকতের মাছ ব্যবসায়ী মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘মাছ ফ্রাইয়ের শতাধিক দোকান রয়েছে। আমরা মাছ ব্যবসায়ীরা এবারের ছুটিতে এসব দোকানে কমপক্ষে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা বিক্রির আশা করেছিলাম। কিন্তু পর্যটক কম থাকায় আমাদের লোকসান হবে বলে মনে হইতেছে।’
কিটকট ছাতার ব্যবসায়ী আবদুল হামিদ বলেন, ‘সাগরপাড়ে ১০টি ছাতা-বেঞ্চ বসিয়ে ব্যবসা করি। গতকাল ঈদের দিন মাত্র ৫০০ টাকা আয় করেছি। আজ দ্বিতীয় দিনে এ পর্যন্ত ৭০০ টাকা আয় করেছি। পর্যটক না এলে আমাদের সংসার চালাতে কষ্ট হইবে।’
ঢাকার ব্যবসায়ী বিপ্লব কুমার মহাজন কুয়াকাটায় সপরিবার বেড়াতে এসেছেন। এর আগেও একাধিকবার কুয়াকাটায় বেড়ানোর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে এই পর্যটক বলেন, ‘এবার এসে সৈকতের শ্রীহীন অবস্থা দেখলাম। সৈকত বলতে এখন ছোট একটা জায়গা। তা–ও কেবল ভাটার সময় দেখা যায়। জোয়ারের সময় সৈকত থাকে না, পুরোটাই তলিয়ে যায়। সৈকত এতটাই ভেঙেছে, যা দেখে কষ্ট পাই। কুয়াকাটাকে বাঁচাতে হলে সৈকতকে রক্ষায় বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে।’
কুয়াকাটায় বেড়াতে এসে পর্যটকেরা ট্যুরিজম পার্ক, জাতীয় উদ্যান (ইকোপার্ক), শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহার, সীমা বৌদ্ধবিহার ঘুরে দেখছেন। এ ছাড়া কুয়াকাটার পশ্চিমে সমুদ্রপথে ফাতরার বন (টেংরাগিরি), সোনাকাটা-ফকিরহাট (ইকোপার্ক), লাল কাঁকড়ার চর, লেম্বুর বন, শুঁটকিপল্লি ঘুরে দেখে ভ্রমণপিপাসুরা আনন্দ পান।
কুয়াকাটার আকর্ষণীয় ও অভিজাত আবাসিক হোটেল সিকদার রিসোর্ট অ্যান্ড ভিলাস। রিসোর্টটির সহকারী ব্যবস্থাপক শাহীন আলম বলেন, ‘আমাদের এখানে ১২টি ভিলাসহ ১৮৬টি কক্ষ রয়েছে। বুকিংয়ের অবস্থা খারাপ। কেবল আজকে এক দিনে ৫০ শতাংশ কক্ষের বুকিং রয়েছে। এবার বড় একটা সময় বন্ধ থাকলেও সব মিলিয়ে ৪০-৫০ শতাংশ কক্ষের বুকিং রয়েছে। গতবারের তুলনায় খুব কম। আমরা পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় সুবিধা দিয়েছি।’
কুয়াকাটা সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যসচিব ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদ–পরবর্তী সময়ে কুয়াকাটায় পর্যটকদের ভিড় বাড়বে এমন ধারণা মাথায় রেখেই আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যটকদের নিরাপত্তায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের একটি দল সার্বক্ষণিক মাঠে থাকবে। এর বাইরে চিকিৎসক দল, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের একটি দলও তৈরি রয়েছে। আমরা পর্যটকদের শতভাগ নিরাপত্তার পদক্ষেপ নিয়েছি।’