রোপণের ২৫ দিন পরও চারায় শিকড় গজাচ্ছে না। চারা তুলে দেখাচ্ছেন কৃষক। কুমারখালীর সান্দিয়ারা মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

চার বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চারা রোপণ করেছেন কৃষক শফিকুল ইসলাম (৫৩)। চারা রোপণের পর ২৫ দিন পেরিয়ে গেছে। এরপর দুবার জমিতে সেচ দিয়েছেন। কিন্তু বড় হওয়ার পরিবর্তে মাথা হলুদ হয়ে ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে পেঁয়াজের চারা।

কৃষক শফিকুলের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার পান্টি ইউনিয়নের সান্দিয়ারা গ্রামে। চার বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চারা রোপণ ও সেচ দিতে তাঁর প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। স্থানীয় বাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা দিয়ে চার কেজি কিং–জাতীয় পেঁয়াজের বীজ কিনেছিলেন। শিকড় না গজানোয় থমকে আছে কৃষক শফিকুলের স্বপ্ন।

শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চারায় শিকড় গজাচ্ছে না। ধীরে ধীরে চারার মাথা মরে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। ভেজাল বীজের কারণেই বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন তিনি।

শুধু শফিকুল নন, এলাকার শতাধিক পেঁয়াজচাষির একই অবস্থা। সান্দিয়ারা গ্রামের কৃষক আজিজুর রহমান বলেন, এলাকার যেসব কৃষক বিদেশি বীজ কিনেছিলেন, তাঁরাই ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

কৃষকেরা বলছেন, প্রতিবছর পেঁয়াজের চারা রোপণের পরপরই জমিতে সেচ দেন কৃষকেরা। সেচের পানি চারায় শিকড় গজাতে ও মাটি আঁকড়ে ধরতে সহযোগিতা করে। কিন্তু এবার জমিতে সেচ দিয়েও চারায় শিকড় গজাচ্ছে না। চারার মাথা হলুদ হয়ে ধীরে ধীরে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। উপজেলার প্রতিটি গ্রামের এক-তৃতীয়াংশ জমির পেঁয়াজখেতেরই এ অবস্থা। 

কৃষকদের অভিযোগ, কৃষি কার্যালয়ের প্রণোদনা কর্মসূচিতে কৃষকদের ভেজাল বীজ দেওয়া হয়েছে। তদারকির অভাবে খোলাবাজারও ভেজাল বীজে সয়লাব। এতেই বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েন তাঁরা। তবে কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, আবহাওয়ার কারণে পেঁয়াজের এমন ক্ষতি হতে পারে।

কুমারখালীর যদুবয়রা ইউনিয়নসহ আশপাশের গ্রামে জেলার সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজের চাষ হয়। উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের বিভিন্ন পেঁয়াজখেত ঘুরে দেখা গেছে, মাঠে কৃষকেরা পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করেছেন। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ পেঁয়াজখেতের চারায় এখনো শিকড় গজায়নি। চারার মাথা হলদে ভাব নিয়ে ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে। কেউ কেউ মরা পেঁয়াজখেতে আবার পেঁয়াজের চারা লাগাচ্ছেন। কেউ কেউ ভুট্টা বা ধানের চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

যদুবয়রা ইউনিয়নের বিল বরইচারা গ্রামের কৃষক তারিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কৃষি কার্যালয় থেকে বিনা মূল্যে এক কেজি বীজ পেয়েছিলেন। আর খোলাবাজার কিনেছিলেন এক কেজি। বীজতলায় ভালো চারা জন্মেছিল এবার। সব মিলে প্রায় দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চারা লাগিয়েছেন তিনি। কিন্তু রোপণের পর সেচ দিলেও এবার চারায় নতুন শিকড় গজায়নি। ১৫ দিনে সব চারা মরে জমিতে মিশে গেছে।

পান্টি ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক মো. মান্নান মোল্লা বলেন, চার বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চারা লাগিয়েছিলেন। দুবার জমিতে সেচ দিয়েও চারা বাঁচাতে পারেননি। এখন পেঁয়াজের জমিতে ভুট্টা আবাদ করবেন তিনি।

চাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদুজ্জামান বলেন, প্রতিবছর প্রণোদনায় কৃষকদের নাম না পাঠিয়ে বিপাকে পড়তেন। আর এবার পেঁয়াজের চারা মরে যাওয়ায় প্রণোদনা পাওয়া কৃষকেরা পথেঘাটে নানা কথা শোনাচ্ছেন। যদুবয়রা ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, তাঁর ইউনিয়ন থেকে এ বছর ১৭ জন কৃষক পেঁয়াজের প্রণোদনার বীজ পেয়েছিলেন। সবারই চারা মরে গেছে। কৃষকদের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর উপজেলার প্রায় ৫ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় ১৩০ জন কৃষককে এক কেজি করে বীজ, ১০ কেজি করে সার, পরিমাণমতো পলিথিন, সুতলি ও ২ হাজার ৮০০ টাকার চেক দেওয়া হয়েছে। কৃষকেরা এখনো পেঁয়াজের চারা রোপণ অব্যাহত রেখেছেন।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাইসুল ইসলাম বলেন, নিয়মিত কৃষকদের খোঁজখবর ও পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। আবহাওয়ার কারণে এভাবে পেঁয়াজের চারা মারা যেতে পারে। বিষয়টি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হায়াত মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, বেশি ঠান্ডার কারণে পরিমাণমতো তাপ পাচ্ছে না পেঁয়াজের চারা। সে জন্য চারা মারা যেতে পারে। ঠান্ডা আবহাওয়ায় কৃষকদের চারা রোপণে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল বলে তিনি দাবি করেন।