লুঙ্গি তৈরির গ্রাম তামাই, আছে ১০ হাজারের বেশি তাঁতকল
সিরাজগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণে জেলার বেলকুচি উপজেলার ‘তামাই গ্রাম’। এই গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা উন্নত মানের রকমারি তাঁতের লুঙ্গি বানানো। এই কাজের জন্য গ্রামটিতে রয়েছে ১০ হাজারের অধিক যন্ত্রচালিত তাঁত (পাওয়ার লুম)। যেখানে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। গ্রামটির প্রায় ৯৫ ভাগ পরিবারের মানুষ কোনো না কোনোভাবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। এই লুঙ্গিশিল্পীদের হাত ধরে গ্রামটিতে এসেছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড সূত্রে জানা যায়, এখানকার তৈরি লুঙ্গির খ্যাতি এখন শুধু দেশে নয়, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা এমনকি মিয়ানমারের কিছু অংশেও ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা এখান থেকে লুঙ্গি কিনে বিদেশেও পাঠান। বিশেষ করে ইউরোপ, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় থাকা প্রবাসীদের মধ্যে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
সম্প্রতি গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ঠিকমতো ফোটার আগেই জেগে উঠেছেন গ্রামটির হাজার হাজার তাঁতশ্রমিকেরা। চারপাশ যখন আবছা অন্ধকারে ঢাকা, তখনই গ্রামটি তাঁতের টুকটাক শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে। গ্রামটিতে গভীর রাত পর্যন্ত চলে তাঁতে লুঙ্গি উৎপাদনের কাজ। উত্তরের রংপুর, কুড়িগ্রাম, পাবনাসহ বিভিন্ন জেলার শ্রমজীবী মানুষ এখানে এসে লুঙ্গি উৎপাদনের কাজ করেন। একটি তাঁতে একজন তাঁতশ্রমিক দিনে ৮ থেকে ১৫টি লুঙ্গি বুনতে পারেন। একজন শ্রমিক পরিচালনা করে থাকেন দুটি করে তাঁত।
৪৫ বছরের বেশি সময় ধরে রকমারি লুঙ্গি উৎপাদন করে আসছেন তামাই গ্রামের রাজবিথি লুঙ্গির স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার বাপ-দাদা এই কাজ করছে। অনেক দিন ধইরা আমিও করতেছি। বর্তমানে আমাদের ৫৫টা তাঁত চলমান। প্রতিদিন পর্যাপ্ত লুঙ্গি উৎপাদন হয়। উৎপাদিত লুঙ্গিগুলোর বেশির ভাগ সেলাইয়ের পর ভাঁজ করে আমাদের রাজবিথি ব্র্যান্ডে বাজারজাত করা হয়। কিছু স্থানীয় হাটসহ লুঙ্গি কোম্পানিগুলোর কাছে গ্রেরে (অপ্রস্তুত) বিক্রি করা হয়ে থাকে।’
সপ্তাহে তিন হাজার টাকা মজুরিতে লুঙ্গি তৈরির সুতা শুকানোর কাজ করছেন আবু হেনা নামের এক যুবক। প্রথম আলোকে জানালেন, সারা বছরেই তাঁদের কমবেশি কাজের চাপ থাকে। তামাই গ্রামের তাঁতশিল্পে লুঙ্গি উৎপাদন ঘিরে অনেক বেকার যুবকের কাজের ব্যবস্থা হয়েছে। ঈদ, পূজা ও রমজান মাস ঘিরে তামাই গ্রামে মানুষের কর্মব্যস্ততা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
তামাই গ্রামে উৎপাদিত লুঙ্গির চাহিদা কমবেশি সারা বছরই থাকে জানিয়ে গ্রামটির দক্ষিণপাড়া এলাকার লুঙ্গি উৎপাদনকারী তাঁতি আমিরুল ইসলাম বললেন, ‘দামে কম, পাকা রংসহ গুণে–মানে ভালো হওয়ার কারণে মানুষ আমাদের গ্রামে উৎপাদিত লুঙ্গি বেশি কেনে।’
গ্রামটির উত্তরপাড়া এলাকার লুঙ্গি উৎপাদনকারী তাঁতি আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সর্বদা উন্নত মানের রং, সুতা ব্যবহার করে নতুন নতুন নকশাতে যন্ত্রচালিত তাঁতে মানসম্মত লুঙ্গি উৎপাদন করে থাকি। যে কারণে দেশের খ্যাতনামা লুঙ্গি বাজারজাত কোম্পানিগুলো আমাদের উৎপাদিত লুঙ্গি কিনে নিয়ে তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডে বাজারে ছাড়ছে।’
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তামাই গ্রামে লুঙ্গি ও শাড়ি তৈরির গোড়াপত্তন হয়েছিল এক শতাব্দীর বেশি আগে। তখন স্থানীয় কারিগরদের দক্ষ হাতে তৈরি উন্নত মানের লুঙ্গি, শাড়ি ও গামছার জন্য এই জেলা বিখ্যাত হয়ে ওঠে। লুঙ্গি তৈরি শাড়ি তৈরির চেয়ে অনেকটাই ঝামেলামুক্ত হওয়ায় এক পর্যায়ে তামাই গ্রামের তাঁতিরা শাড়ি উৎপাদন বাদ দিয়ে ধীরে ধীরে লুঙ্গিতে বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠেন। লুঙ্গি উৎপাদন করেই এই গ্রামের তাঁতিদের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এই সময়েই তাঁতিরা তাঁদের হস্তচালিত তাঁত বিক্রি করে যন্ত্রচালিত তাঁত কিনতে শুরু করেন। গ্রামটিতে বর্তমানে হস্তচালিত তাঁত নেই বললেই চলে। ১০ হাজারের অধিক যন্ত্রচালিত তাঁত রয়েছে। এসব তাঁতে ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকা দামের লুঙ্গিও তৈরি হয়ে থাকে।
এ গ্রামে কাজের সুবাদে অনেক পরিবারের অর্থনৈতিক চিত্র বদলে গেছে। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার পচাকাটা গ্রামের একরামুল হোসেন (৪০) তামাই গ্রামে এসে ১০ বছর ধরে তাঁতে লুঙ্গি বুননের কাজ করছেন। এতে তাঁর পরিবারে বেশ সচ্ছলতা এসেছে। একরামুল হোসেন বলেন, আগে তাঁর পরিবারে শুধু বাবা আয় করতেন। এলাকায় রিকশা চালিয়ে বাবার যা আয় হতো তা দিয়ে মা, বাবা, ভাইবোনসহ ছয় সদস্যের সংসারে দুবেলা খেয়ে না খেয়ে থাকতে হতো। তামাই গ্রামে একরামুলের সঙ্গে তাঁর ভাইও লুঙ্গি বুনন করেন। এতে খাবার খরচ বাদ দিয়েও প্রতি সপ্তাহে দুই ভাই মিলে ১০ হাজার টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারছেন। এতে তাঁদের পরিবারে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরেছে।
তামাই গ্রামে এসে নলিতে সুতা পাকানোর কাজ করেন জাহানারা আক্তার। তাঁর বাড়ি পাশের দেলুয়াকান্দি গ্রামে। প্রায় আট বছর ধরে তিনি তামাই গ্রামে লুঙ্গি সুতা পাকানোর কাজ করেন। প্রতি সপ্তাহে বেশ ভালোই আয় করেন। সেই টাকায় পরিবার এখন বেশ সচ্ছল। এতে তিনি আনন্দিত। লুঙ্গি তৈরির তামাই গ্রামে জাহানারার মতো অসংখ্য নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে।
ফকিরপাড়া এলাকার লুঙ্গি উৎপাদনকারী তাঁতি শামীম মল্লিক জানান, লুঙ্গি উৎপাদন করেই গত দুই দশকে এই এলাকার মানুষের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ইতিমধ্যে এই গ্রামের অনেক তাঁতি লুঙ্গি উৎপাদন করে তাঁদের নিজেদের ব্র্যান্ডের নামে বাজারজাত করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, বর্তমানে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে এ লুঙ্গি শুধু একটি পণ্য নয়, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্মে বয়ে চলা এক উত্তরাধিকার, জীবন-জীবিকার মূল অবলম্বন। এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের টিকে থাকার সংগ্রামের এক জীবন্ত স্মারক, শতবর্ষী এক গল্প, যা আজও বোনা হচ্ছে—এক একটি সুতোর টানে।