সকালে শীতের দাপট কিছুটা বেশি থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কমতে শুরু করে। তবে শীত উপেক্ষা করে সকাল থেকেই কৃতী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে বরিশালের কীর্তনখোলার তীরে অবস্থিত শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। নির্ধারিত বুথ থেকে ক্রেস্ট, স্ন্যাকস ও ডিজিটাল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠেন এইচএসসির কৃতী শিক্ষার্থীরা। জীবনের লক্ষ্য লেখার বোর্ডে অনেকে লিখছিলেন নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। এসব লেখায় মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, বৃত্তি নিয়ে বিদেশ গমন বা ভালো মানুষ হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন শিক্ষার্থীরা।
এভাবেই ‘স্বপ্ন থেকে সাফল্যের পথে, একসাথে’ স্লোগানে সোমবার (৮ ডিসেম্বর) দিনভর কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মশহর বরিশালে অনুষ্ঠিত হলো প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি ও প্রথম আলো আয়োজিত এই কৃতী শিক্ষার্থী উৎসব।
উৎসবে অংশ নিতে সকাল ৯টার আগেই শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণে পৌঁছান শিক্ষার্থীরা। অনেক দিন পর সহপাঠী-বন্ধুদের দেখা পেয়ে উচ্ছ্বসিত সবাই। তাঁরা গল্প-আড্ডায় মেতে ওঠেন, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ছবি তোলেন, ভাগাভাগি করেন ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথা। সবাই মিলে হাসিমাখা মুখে সেলফি তোলেন।
আমিনুল ইসলাম এবার বরিশাল সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ থেকে এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। এসএসসিতেও জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর লক্ষ্য একজন প্রকৌশলী হওয়া। এ জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েটে) ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁর আত্মবিশ্বাস এবারও তিনি জয়ী হবেন।
বরিশালের হিজলা সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া শামীমা ইয়াসমিন (শাম্মী), ঝালকাঠির নলছিটির মারিয়া আক্তার জানান, ভালো ফলাফল করার পর দায়িত্ব বেড়ে গেছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ভালো প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পড়াশোনার চাপের কারণে এইচএসসিতে ভালো ফলাফলের আনন্দটা উদ্যাপন করার সময় হয়নি তাঁদের। উদ্যাপনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য প্রথম আলোর প্রতি ধন্যবাদ জানান তাঁরা। দিনভর ক্যারিয়ার, উচ্চশিক্ষা নিয়ে আলোচনা এবং জনপ্রিয় শিল্পীদের গানে গানে এমন আয়োজনে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন।
সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এ সময় দাঁড়িয়ে সবাই জাতীয় সংগীতের সঙ্গে গলা মেলান। পরে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর বরিশালের নিজস্ব প্রতিবেদক এম জসীম উদ্দীন।
এরপর শুরু হয় প্রথম পর্ব: ক্যারিয়ার, উচ্চশিক্ষার নানা বিয়য় নিয়ে কয়েকটি সেশন। পরীক্ষার প্রস্তুতি ও ক্যারিয়ার সেশনটি সঞ্চালনা করেন ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রফেশনাল ফেলো জাহিদ হোসাইন খান। এতে আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আহমেদ সৌরভ, মজার ইশকুলের প্রতিষ্ঠাতা আরিয়ান আরিফ, গবেষক রুবিনা হক। আলোচনায় করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বর্ষা ইসলাম, আবু সাঈদ, হৃদয় চন্দ্র দে, মরিয়ম ফেরদৌসী মেরী।
পর্যায়ক্রমে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেসের ডিন আনোয়ারুল কবির, ‘স্কুল অব ল’-এর ডিন মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা ও বিভাগীয় সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে বক্তব্য দেন।
এরপর মঞ্চে আসেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক আনিসুল হক। জীবনে সফলতার জন্য স্বপ্ন থাকা জরুরি উল্লেখ করে শিক্ষার্থীদের তিনি বলেন, ‘স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাধা আসবে, কিন্তু তা অতিক্রম করা যায়। পৃথিবীর সব মানুষ কোনো না কোনোভাবে জিনিয়াস। জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা শক্তিশালী; কল্পনা বাড়াতে বই পড়তে হবে—কাগজের বই ও জীবনের বই দুটোই। বই না পড়ে কেউ বড় হতে পারে না।’
মা–বাবার জন্য লজ্জাজনক হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন কিছু না লেখার পরামর্শ দিয়ে আনিসুল হক বলেন, ‘যা তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে শেয়ার করা যায় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে, তা–ই লিখবে।’
মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪-এর বিপ্লবের শহীদদের জীবন উৎসর্গের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে আনিসুল হক বলেন, ‘আমরা একটি সুন্দর দেশ চাই, যে দেশের জন্য আমাদের শহীদেরা রক্ত দিয়েছিল। তোমাদের মেধা, মননশীলতা দিয়ে সেই দেশ গড়ে তুলতে হবে।’
এ সময় মিথ্যা, মাদক, মুখস্থ থেকে কৃতী শিক্ষার্থীদের দূরে থাকার জন্য শপথ পাঠ করান আনিসুল হক। সেই সঙ্গে ভালো ফলাফলের পাশাপাশি অনুভূতিশীল মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার পরামর্শ দেন। আনিসুল হকের প্রশ্নের জবাব দিয়ে পুরস্কার জিতে নেন শিক্ষার্থীরা। তিনি বিজয়ী শিক্ষার্থীদের হাতে নিজের লেখা বই পুরস্কার হিসেবে তুলে দেন।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে মঞ্চে আসেন বন্ধুসভার নির্বাহী সভাপতি মৌসুমী মৌ। তিনি মঞ্চে ডাকেন সংগীতশিল্পী মিথুন রায়কে। মিথুন রায় ও তাঁর দল গান গেয়ে মুগ্ধ করেন সবাইকে। এরপর মঞ্চে আসেন অভিনেত্রী প্রার্থনা ফারদিন দীঘি ও কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার (সোহাগ)। তাঁরা একটি গানের তালে নৃত্য পরিবেশন করেন।
এরপর একে একে মঞ্চে আসেন লেখক আনিসুল হক, বিশিষ্ট গীতিকার কবির বকুল, অভিনেত্রী প্রার্থনা ফারদিন দীঘি, শিল্পী অনিমেষ রায়, পান্থ কানাই, কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার। তাঁরা কৃতী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছবি তোলেন। সবশেষে মঞ্চ মাতান শিল্পী অনিমেষ রায়, পান্থ কানাই। তাঁদের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠেন শিক্ষার্থীরাও।
শিক্ষার্থীদের জন্য অনুষ্ঠানস্থলে বসানো হয় ফটো বুথ, ৩৬০ ডিগ্রি সেলফি বুথ। প্রথম আলোর স্টলে সাধারণ জ্ঞান নিয়ে ছিল কুইজ। দক্ষতা নিয়ে ছিল প্রতীকী ভোট। কুইজে অংশ নিয়ে অনেকে পুরস্কার জেতেন। অনুষ্ঠানস্থলে প্রাথমিক চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করেন বরিশালের বেসরকারি জমজম আইএইচটি, ম্যাটস অ্যান্ড নার্সিং কলেজ। এ ছাড়া ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকি ও প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির স্টলে ছিল চোখে পড়ার মতো ভিড়। দিনভর নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বেলা তিনটায় শেষ হয় কৃতী শিক্ষার্থীদের এই মিলনমেলা।