দাবদাহে মেহেরপুরে ঝরে পড়ছে আম-লিচুর গুটি
চলতি মৌসুমে আম-লিচুর মুকুল বেরিয়েছে ৬৫ শতাংশ। বাকিটায় নতুন পাতা বের হয়েছে।
অতিমাত্রার গরমে মেহেরপুরের আম-লিচুর গুটি ঝরে পড়ছে। এভাবে গুটি ঝরে পড়তে থাকলে বাগানমালিকেরা মোটা অঙ্কের লোকসানে পড়বেন বলে আশঙ্কা করছেন। বাগানমালিকেরা বলেন, এখন বৈরী আবহাওয়া। রাতে ঠান্ডা ভাব, দিনে দাবদাহ। আর এ কারণে ঝরে যাচ্ছে গুটি। ফলে চলতি মৌসুমে আম-লিচুর ফলনে বিপর্যয় হতে পারে।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ মৌসুমে মেহেরপুর জেলাতে ৪০ ডিগ্রির ওপর রেকর্ড করা হচ্ছে কয়েক দিন ধরে। গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা মানুষের। আবহাওয়া অফিসের জ্যৈষ্ঠ পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান জানান, মেহেরপুর জেলায় দীর্ঘদিন থেকেই বৃষ্টি নেই। এর প্রভাব ফসলের ওপর পড়ছে। তবে এমন পরিস্থিতি কবে নাগাদ পরিবর্তিত হবে, বলা যাচ্ছে না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি মৌসুমে আম-লিচুর মুকুল বেরিয়েছে ৬৫ শতাংশ। বাকিটায় নতুন পাতা বের হয়েছে। অন্যদিকে বর্তমানে আম-লিচুর জন্য প্রতিকূল আবহাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে এবার আম-লিচুর ফলন কিছুটা কমার আশঙ্কা আছে। জেলায় লিচুর বাগান রয়েছে ৮০০ হেক্টর জমিতে। এসব বাগানে, আঁটি লিচু, বোম্বাই, চিলি বোম্বাই, আতা-বোম্বাই ও চায়না-থ্রি জাতের লিচু উৎপাদন হয়। চলতি বছরে জেলায় সাড়ে ৮ হাজার টন লিচুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আমের বাগান রয়েছে ৩ হাজার ৩৩৬ হেক্টর। ল্যাংড়া, বোম্বাই, হিমসাগর, ফজলি, আম্রপালি, গোপালভোগ, হাঁড়িভাঙাসহ বেশ কয়েকটি জাতের আমবাগান রয়েছে।
সদর উপজেলার শিবপুর গ্রামে ১৭ একর জমিতে আম-লিচুর বাগান রয়েছে। সেই বাগানে ল্যাংড়া, হিমসাগর, বোম্বায় আমের গাছ রয়েছে বেশি। চলতি সপ্তাহে ওই বাগানে গিয়ে দেখা যায়, গাছের নিচে ঝরে পড়া আমের স্তূপ। অথচ গাছে তেমন গুটি নেই।
উপজেলার আমঝুপি, বাড়াদি, হরিরামপুর, কালিগাংনী, শ্যামপুর, উজলপুর, কুলবাড়িয়াসহ গাংনী উপজেলার, নওয়াপাড়া, সাহারবাটি, তেঁতুলবাড়িয়া, বামুন্দি গ্রামে দেখা যায়, লিচুগাছ এখন হলুদরঙা মুকুলে ছেয়ে আছে। কিছু গাছে মুকুল থেকে বেরিয়েছে গুটি। বাগানে ঢুকলেই চোখে পড়ছে গুটি ঝরার দৃশ্য। চাষিরা গুটি ঝরা রোধে নানা চেষ্টা করছেন। কেউ ওষুধ ছিটাচ্ছেন, কেউ স্প্রের যন্ত্র দিয়ে পানি দিচ্ছিলেন।
আমঝুপি এলাকার কোলা ও দফরপুর গ্রামের বাগানমালিক লিয়াকত হোসেন বলেন, তাঁর দুই বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের আমবাগান রয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবারে হিমসাগর আমগাছে আশানুরূপ মুকুল আসেনি। এরপর অতিমাত্রার গরমে আমের গুটি ঝরে পড়ছে। কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী, বাগানে সেচ দেওয়া হচ্ছে এবং নানা প্রকারের ছত্রাকনাশক ছিটিয়েও তেমন উপকার পাওয়া যাচ্ছে না।
ঝাউবাড়িয়া গ্রামের বাগানমালিক মিলন খাঁ বলেন, সাড়ে তিন বিঘা জমিতে লিচুর বাগান রয়েছে। বাগানে আগাম জাতের আঁটি লিচু রয়েছে দেড় বিঘা। আঁটি লিচুগাছের ডগায় ডগায় মুকুলে ছেয়ে গেছে। বাকি জমিতে রয়েছে বোম্বাই লিচুর গাছ। সেগুলোতে মুকুল দেখা দিয়েছে। কিন্তু সব গাছেই এখন লিচুর গুটি। গুটির ডগা শুকিয়ে যাচ্ছে এবং একটু বাতাস হলেই ঝরে পড়ছে। এ বছর লিচুর ফলন বিপর্যয় ঘটবে।
চাষিরা বলেন, মেহেরপুরে হিমসাগর ও বোম্বাই জাতের আমের কদর রয়েছে সারা দেশেই। লিচু বোম্বাই, মোজাফ্ফর ও দেশি জাতের লিচুর চাষ হয়। ফলে প্রতিবছর মৌসুম শুরুর আগেই পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাগানের আম-লিচু কিনে নেন। এর পর থেকে আম-লিচু তোলা ও বাজারজাতের দায়িত্বটা তাঁরাই পালন করেন। কিন্তু চলতি মৌসুমে আম-লিচুর ফলন কম। তাঁদের হিসাবে, গত বছরের তুলনায় অর্ধেক মুকুল এসেছে। অন্যদিকে বর্তমানে লিচুর জন্য বিরূপ আবহাওয়া রয়েছে। রাতে শীত ও কুয়াশা ভাব থাকছে। দিনে হচ্ছে দাবদাহ। অনেক দিন ধরে বৃষ্টিও হচ্ছে না। এ কারণে প্রতিদিন প্রচুর আম-লিচু গুটি ঝরে যাচ্ছে। তাই পাইকারেরা লোকসানের ভয়ে বাগান কিনছেন না। এতে চাষিরা চরম বিপাকে পড়েছেন।
আম-লিচুর মৌসুমি ব্যবসায়ী চান্দ মিয়া বলেন, গাছে মুকুল আসার সঙ্গে সঙ্গে জেলার কয়েকটি এলাকায় ২০ বিঘা আমবাগান ও ১০ বিঘা লিচুর বাগান চলতি মৌসুমের জন্য ফলের ইজারা নিয়েছেন। টানা গরম আর অনাবৃষ্টির কারণে আম-লিচুর গুটি ঝরে পড়ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ সামসুল আলম বলেন, প্রচণ্ড তাপের কারণেই আমের গুটি ঝরে যাচ্ছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে চাষিদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যেসব বাগানে আম ও লিচুর গুটি ঝরে যাচ্ছে, বিকেলের দিকে পরিমিত মাত্রায় বোরন স্প্রে করলে গুটিঝরা রোধ করা যাবে। তাপমাত্রা বেশি, তাই গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে। তাহলে গুটিঝরা রোধ হয়ে যাবে। এতে কিছুটা হলেও উপকার পাওয়া যাবে। এ ছাড়া নিয়মিত সেচ দেওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।