ভীতির পরিবেশেও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেছে প্রথম আলো

প্রথম আলোর ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজশাহীতে আয়োজিত সুধী সমাবেশে উপস্থিত গুণীজনেরা। আজ শনিবার বিকেলে রাজশাহী নগরের অলকার মোড়ে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মিলনায়তনেছবি: শহীদুল ইসলাম

নানা চড়াই-উতরাই ও ভীতির পরিবেশেও প্রথম আলো সাহসিকতা ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ধারা বজায় রেখেছে। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় যে ভীতি ও চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছিল, তা মোকাবিলা করে পত্রিকাটি মানুষের আস্থার জায়গা ধরে রেখেছে।

প্রথম আলোর ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আজ শনিবার বিকেলে রাজশাহীতে আয়োজিত সুধী সমাবেশে বক্তারা এ কথা বলেন। নগরের অলকার মোড়ে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মিলনায়তনে আয়োজিত এই সুধী সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। সমাবেশ সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ। অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গণমাধ্যমের সম্পাদক, শিক্ষক, সমাজকর্মী, কৃষি উদ্যোক্তা, কর্মকর্তা, সংবাদপত্র এজেন্টসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন এবং তাঁদের মতামত তুলে ধরেন।

সুধী সমাবেশে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। আজ শনিবার বিকেলে রাজশাহী নগরের অলকার মোড়ে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মিলনায়তনে
ছবি: শহীদুল ইসলাম

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সুধী সমাবেশে বক্তারা বলেন, সমাজ গড়ার কাজে প্রথম আলোকে আরও এগিয়ে আসতে হবে, প্রথম আলোর সে সক্ষমতা আছে। গণমাধ্যমটির প্রতি পাঠকের আস্থাও আছে। অনুষ্ঠানে বক্তারা প্রথম আলোর ২৭ বছরের যাত্রাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি যেন ভবিষ্যতেও সত্য প্রকাশের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সাংবাদিকতা চালিয়ে যায়।

নারী ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আরও কাজ করার আহ্বান জানিয়ে সুধী সমাবেশে সমাজকর্মী কল্পনা রায় ভৌমিক বলেন, ‘আমি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে স্কুল পরিচালনা করেছি। এই বিদ্যালয় করতে গিয়ে এত সমস্যা, এত বাধা এসেছে। ওই সময় প্রথম আলো পাশে ছিল। প্রতিবন্ধী শিশুদের সাফল্য ও তাদের সংগ্রাম নিয়ে প্রথম আলো যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে, তা প্রশংসনীয়। তবে সপ্তাহে অন্তত একটি পাতা প্রতিবন্ধী ও তাদের অভিভাবকদের জন্য বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।’

সুধী সমাবেশে সমাজকর্মী কল্পনা রায় ভৌমিক
ছবি: প্রথম আলো

পুঠিয়ার ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দিলরুবা খাতুন বলেন, ‘আমি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ের পুরস্কার পেয়েছি। কিন্তু প্রথম আলোর “প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা” পাওয়ার আনন্দ ছিল অন্য রকম। এটি শিক্ষকদের জন্য এক বিশাল প্রাপ্তি।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহী জেলার সভাপতি আহমদ সফি উদ্দিন সাংবাদিকতায় নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এবং সিনিয়র সিটিজেনদের (প্রবীণ নাগরিক) জন্য বিশেষ পাতা চালুর দাবি জানান। এ ছাড়া সীমান্তের মানুষের খবর, সড়কে নিরাপত্তা, খাদ্যনিরাপত্তা, খেলাধুলার পাতায় গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্রীড়াচর্চাকে তুলে ধরার এবং আন্তর্জাতিক পাতায় রাজনীতির বাইরে সামাজিক উন্নয়নের খবর প্রকাশের অনুরোধ করেন।

সুধী সমাবেশে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহী জেলার সভাপতি আহমদ সফি উদ্দিন
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশ বেতারের রাজশাহীর ধারাভাষ্যকার আবদুর রোকন মাসুম প্রথম আলোর সত্য উদ্‌ঘাটনের তিনটি প্রতিবেদনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘কেন প্রথম আলো পড়ি? কেন ভালোবাসি? কেন প্রথম আলো ছাড়া অন্য কোনো পত্রিকায় নজর দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না? মূলত সত্য প্রকাশ এবং অকপটে প্রকাশের জন্য।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোহা. ফরিদ উদ্দীন খান বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা নেই, সরকারের প্রতি আস্থা নেই, অনেক ক্ষেত্রে আস্থা নেই। কিন্তু এমন একটা পত্রিকা বাংলাদেশে আমাদের সামনে আছে—প্রথম আলো, যার ওপরে মানুষের আস্থা আছে। এটা একটা বড় অর্জন। আমি ব্যক্তিগতভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন কোনো নিউজ দেখি, তারপর আমি চেক করি যে প্রথম আলোতে এটা আসছে কি না। যতক্ষণ না প্রথম আলোতে এটা দেখি, ততক্ষণ সেই সংবাদটা সম্পর্কে আমার আস্থাটা জন্মে না।’

সুধী সমাবেশে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ইকবাল মতিন
ছবি: প্রথম আলো

অনুষ্ঠানে রাজশাহী মহানগর সংবাদপত্র শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি দুলাল হোসেন বলেন, অনেক শিক্ষার্থী সকালে ফোন করে প্রথম আলো পত্রিকা কিনতে চান, যা পত্রিকাটির প্রতি তাঁদের ভালোবাসার প্রমাণ।

সমাবেশে পাঠকেরা ছাপা সংস্করণের খবরের নিচে অনলাইন লিংক বা কিউআর কোড যুক্ত করার প্রস্তাব দেন। এ ছাড়া ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য ও গবেষণাধর্মী লেখার পরিমাণ বাড়ানোর অনুরোধ জানান পাঠকেরা।

সুধী সমাবেশে প্রথম আলো নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। প্রথম আলো সম্পাদক উপস্থিত পাঠকের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, রাজশাহীর সঙ্গে প্রথম আলোর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে এবং এই অঞ্চল সব সময়ই পত্রিকার বড় পাঠক ভিত্তি তৈরি করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা গেছে, ছাপা ও অনলাইন মিলিয়ে দেশের মোট পাঠকের ৫৭ শতাংশ প্রথম আলো পড়েন এবং ৬৪ জেলার মধ্যে ৬১ জেলায় প্রথম আলো শীর্ষে আছে। তিনি জানান, ১৯৯৮ সালে প্রথম আলো যাত্রা শুরুর সময় লক্ষ্য ছিল সত্যনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন এবং নিজস্ব আয়ে টিকে থাকা। তখন ১৬ পৃষ্ঠা দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে তা সর্বোচ্চ ৪০ পৃষ্ঠা ছাপা হয়েছে এবং একসময় প্রতিদিনের ছাপার সংখ্যা ৫ লাখের বেশি হয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। তিনি বলেন, ডিজিটাল যুগে ছাপা সংস্করণের ওপর চাপ বাড়লেও অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রথম আলোর অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক।

মানুষের আস্থা অটুট রাখতে প্রথম আলো প্রতিদিন যাচাই-বাছাই, ফ্যাক্ট-চেকিং ও সতর্কতার ওপর জোর দিচ্ছে বলে সুধী সমাবেশে জানান সম্পাদক মতিউর রহমান। আজ শনিবার বিকেলে রাজশাহী নগরের অলকার মোড়ে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মিলনায়তনে
ছবি: শহীদুল ইসলাম

প্রথম আলো সম্পাদক বলেন, সংবাদমাধ্যম এখন ‘প্রিন্ট ফার্স্ট, অনলাইন ফার্স্ট, মোবাইল ফার্স্ট, ভিডিও ফার্স্ট’ যুগ পার হয়ে ‘এআই ফার্স্ট’ যুগে প্রবেশ করেছে। প্রযুক্তির এই দ্রুত পরিবর্তন সাংবাদিকতার সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত রাখা এবং মিথ্যা তথ্য, অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা।

মানুষের আস্থা অটুট রাখতে প্রথম আলো প্রতিদিন যাচাই-বাছাই, ফ্যাক্ট-চেকিং ও সতর্কতার ওপর জোর দিচ্ছে জানিয়ে সম্পাদক বলেন, অতীতে বিভিন্ন সরকারের সময় বিজ্ঞাপন বন্ধ হওয়া, মামলা, হুমকি, প্রচারে বাধা সৃষ্টি—সবকিছুই প্রথম আলোর ওপর এসেছে। এমনকি সংসদে প্রথম আলোকে ‘শত্রু’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তবু সত্য প্রকাশের নীতি থেকে পত্রিকা সরে যায়নি এবং পাঠকদের সমর্থনেই এগিয়ে চলছে।

মতিউর রহমান বলেন, প্রথম আলোর উদ্দেশ্য কখনোই রাজনৈতিক এজেন্ডা নয়; বরং ভালো সাংবাদিকতা, সত্য প্রকাশ এবং মানুষের জীবনের উন্নয়নে অবদান রাখা। তাই শুধু সংবাদ নয়, প্রথম আলো বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগও চালিয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, আলোর পাঠশালা, দুর্গম অঞ্চলে স্কুল পরিচালনা, চরের নামকরণ, রাস্তা নির্মাণে জনমত সৃষ্টি, নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে দীর্ঘ কর্মসূচি, মাদকবিরোধী সভা—এসবই পাঠকের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে কাজ করেছে। তিনি আরও জানান, আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল প্রতিযোগিতার মতো জাতীয় উদ্যোগও তরুণসমাজকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখছে।

সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, সব চাপ-বাধা সত্ত্বেও সত্য, সততা ও পাঠকের বিশ্বাসই প্রথম আলোর শক্তি, আর সেই শক্তির ভিত্তিতেই আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা হবে।

সুধী সমাবেশে অনুভূতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন রাজশাহীর পুঠিয়ার ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দিলরুবা খাতুন
ছবি: প্রথম আলো

সুধী সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন, নদী গবেষক ও লেখক মাহবুব সিদ্দিকী, রাজশাহী জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি কল্পনা রায়, রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান, রাজশাহী রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, শাহ কৃষি পাঠাগার ও জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা জাহাঙ্গীর আলম শাহ, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও গ্রামোফোন সংগ্রাহক ইকবাল মতিন, কবি মোস্তাক রহমান, দৈনিক সোনালী সংবাদের সম্পাদক লিয়াকত আলী, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) রাজশাহী মহানগরের আহ্বায়ক মো. মোবাশ্বের আলী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাজ্জাদ বকুল, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিচালক মো. শামীম আহসান, স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী নূর মোহাম্মদ প্রমুখ।