চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোলের ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্রের ৯৭তম জন্মবার্ষিকী আজ মঙ্গলবার। দিনটি উপলক্ষে স্থানীয় একটি সংগঠন কর্মসূচি পালন করবে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে নেই কোনো আয়োজন। এমনকি ইলা মিত্র নাচোলের যেসব গ্রামের সাঁওতাল আদিবাসীদের নিয়ে তেভাগা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তাঁদের স্মৃতিও সংরক্ষণ করা হয়নি।
স্বজনদের আক্ষেপ, এমন বড় একটি আন্দোলন যে হয়েছিল, তার কোনো নামনিশানাই পাওয়া যাবে না নাচোলে। এই সংগ্রামীদের স্মরণ ও স্মৃতি সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
স্থানীয় একাধিক প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। খোঁজ করা হয় ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ইলা মিত্রের সহযোদ্ধাদের স্বজনদের। তবে আন্দোলনে ঘাঁটি অঞ্চল নাচোলের কেন্দুয়া, ঘাসুড়া, রাওতারা,চণ্ডীপুর ও আশপাশের গ্রামের তেভাগা আন্দোলনকারীদের স্বজনদের কাউকে পাওয়া যায়নি।
তবে ঘাঁটি এলাকার নিকটবর্তী নাচোলের বরেন্দা গ্রামের কয়েকজন আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে নির্যাতিত ও কারাবরণকারী সোমরা মুন্ডা ও নগেন মুন্ডার স্বজনদের খোঁজ পাওয়া যায়।
বরেন্দা গ্রামের প্রবীণ ঝড়ু মুন্ডা আন্দোলনের সময় ছিলেন ১০-১২ বয়সের বালক। এ গ্রামে স্মৃতি হাতড়ে কিছু বলতে পারেন কেবল তিনিই। রোববার দুপুরে বরেন্দা গ্রামে তাঁর বাড়িতে বসে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সোমরা মুন্ডা তাঁর ফুফা। রাজশাহী কারাগারে বন্দী অবস্থায় মৃত্যু হয় তাঁর। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ পরিবারের কাছে লাশ ফিরিয়ে দেয়নি। মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর লোকমুখে সেই খবর পান। স্বজনেরা ভয়ে কেউ কারাগারে গিয়ে খোঁজ নিতে পারেননি।
ঝড়ু মুন্ডা আরও বলেন, ১১ মাস কারাবাসের পর ফিরে আসেন আন্দোলনের কর্মী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও বরেন্দা গ্রামের নগেন মুন্ডা, হাসরু ওঁরাও, লুগু ওঁরাও, বাবলা মুন্ডা, মাকুয়া ওঁরাও। তখন সোমরা মুন্ডার মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হন। বাবলা মুন্ডা ও মাকুয়া ওঁরাও বৃদ্ধ বয়সেই কারাভোগ করেছিলেন। গ্রাম থেকে তাঁদের ধরে নিয়ে যান আনসার সদস্যরা। এরপর কারাগারে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। গ্রামের মহব্বত মোড়ল নামের একজন জোতদার পুলিশকে তাঁদের বিষয়ে তথ্য দেন। নগেন মুন্ডার বাড়িতে তল্লাশি করে পাওয়া যায় কমিউনিস্ট পার্টির চাঁদা আদায়ের রসিদ বই। তাঁর ওপরই নির্যাতন হয় বেশি।
ইলা মিত্রের সহযোদ্ধা বাবলা মুন্ডা, হাসরু ওঁরাও, মাকুয়া ওঁরাও বাবলা মুন্ডার স্বজনদের কেউ আর দেশে নেই বলেও জানান ঝড়ু মুন্ডা।
ওই গ্রামেই থাকেন সোমরা মুন্ডার নাতি সখিন মুন্ডা (৫৫) ও নাতনি নলনী মুন্ডা (৪৮)। আছেন নগেন মুন্ডার তিন ছেলে রামলাল মুন্ডা (৬৫), মতিলাল মুন্ডা (৬৫) ও রতিলাল মুন্ডা (৫৮)। রতিলাল মুন্ডা বলেন, তেভাগা আন্দোলনে তাঁর বাবাসহ গ্রামের কয়েকজনের আত্মত্যাগ থাকলেও ইতিহাসের পাতায় তাঁদের কোনো নাম নেই। কোনো গবেষকও কখনো গ্রামে খোঁজখবর করতে আসেননি।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) এই সদস্য বলেন, ‘বাবার আদর্শ ধারণ করি। সমাজতন্ত্রের রাজনীতি করি। বাবা তো মেহনতি মানুষদের জিতিয়ে যেতে পারেননি। আমার জীবদ্দশায় জিত না হলেও আমার সন্তানদের সময় হবে। সন্তানকেও বলে যাব, সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যেন থাকে।’
কথা বলার সময় লাঠিতে ভর দিয়ে আসেন প্রবীণ গোবরি মুন্ডা (৭২)। স্মৃতি হাতড়ে তেমন কিছু মনে করতে না পারলেও বলেন, সেসব দিনের কথা মনে পড়লে এখনো বুক কাঁপে। সোমরার নাতনি নলনি মুন্ডা কিছু না বলতে পারেন না। শুধু চোখ মোছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রগতিশীল নারীদের সংগঠন ‘জাগো নারী বহ্নিশিখা’ আজ ইলা মিত্রের ৯৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।