গ্রীষ্মের ডাক পেলেই গাছটি সেজে ওঠে ফুলের রঙে

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার শহরশ্রীর একটি বাড়িতে আছে দুর্লভ গাছ ‘নাগলিঙ্গম’ছবি: প্রথম আলো

‘এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্ণে শান্তি আসে মানুষের মনে/ এখানে সবুজ শাখা আঁকাবাঁকা হলুদ পাখিরে রাখে ঢেকে/ জামের আড়ালে সেই বউ কথাকওটিরে যদি ফেল দেখে/ একবার—একবার দু’পহর অপরাহ্ণে যদি এই ঘুঘুর গুঞ্জনে/ ধরা দাও—তাহলে অনন্তকাল থাকিতে যে হবে এই বনে।’ ইচ্ছে হলেও অনন্তকাল হয়তো এখানে থাকার সুযোগ নেই। স্থানটিও ঠিক বন নয়, তবে অনেকটা বনের মতো। চেনা-অচেনা গাছপালা, শটিবন, বাঁশঝাড়, আম-কাঁঠালের ছায়ায় নিবিড় এক সবুজ গ্রাম। গাছের আড়ালে বসে দু-একটি কোকিল, দু-একটি ঘুঘু পাখি যখন-তখন ডেকে ওঠে, গুঞ্জন তোলে।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের শহরশ্রী নামের সেই গ্রামের একটি বাড়িতে একটি দুর্লভ গাছ আছে। যে গাছটি প্রায় অর্ধশতক ধরে ফুলের ঐশ্বর্য নিয়ে বাড়িটিকে রঙিন করছে। প্রকৃতি গ্রীষ্মের ডাক পাঠালেই গাছটিতে ফুল ফুটে। সেই গাছটির শরীর ফেটে এখন উপচে পড়ছে ফুল, ঢেউ খেলে ফুলের বন্যা বইছে। সাপের ফণার মতো বাঁকানো উদ্যত অজস্র স্নিগ্ধ, উজ্জ্বল ফুল ফুটেছে গাছটিতে। ফুলে ফুলে ঢাকা পড়েছে গাছের শরীর, বাকল, শাখা-প্রশাখা। গাছটির চারপাশে হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে ফুলের মধুগন্ধ। দুর্লভ গাছটির নাম ‘নাগলিঙ্গম’।

শহরশ্রী খুব দূরে নয়, তবু শহর থেকে অনেকটা দূরেই। শহরশ্রীর অবস্থান শ্রীমঙ্গল উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নে। উঁচু-নিচু টিলায় সাজানো গ্রামটি। ওই বাড়ির মালিক অবসরপ্রাপ্ত নৌ কর্মকর্তা দেওয়ান গউছউদ্দিন আহমদ। স্থানীয় জাতেরসহ অনেক বিরল প্রজাতির গাছ আছে এই বাড়িতে। সেই বিরল প্রজাতিরই একটি হচ্ছে নাগলিঙ্গম। প্রায় ৬০ বছর আগে তাঁর বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা দেওয়ান মহীউদ্দিন আহমদ নার্সারি থেকে একটি ফুলের চারা এনে বাড়িতে রোপণ করেছিলেন। তখনো এটা কী জাতের ফুলের গাছ, তা তাঁরা জানতেন না। ধীরে ধীরে গাছটি বড় হয়েছে, একসময় গাছে ফুল এসেছে। তারপর খোঁজখবর নিয়ে ফুলের জাত চেনা গেছে।

চৈত্রের শেষ থেকে ফুল ফুটতে শুরু করে, ভাদ্র মাস পর্যন্ত ফুল ফুটে। অজস্র ফুলে গাছটি রঙিন হয়ে ওঠে। সকালে এই ফুল থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। পুরোনো গাছটির পাশে প্রাকৃতিকভাবে আরও দুটি গাছ উঠেছে। নাগলিঙ্গম গাছটিতে এখন ফুলের ঢল নেমেছে। গাছটির প্রায় পুরো শরীর ফুলে ঢেকে গেছে। ফুলের রঙে সেজে উঠেছে গাছ। সাপের ফণার মতো ফুটে আছে ফুল। কোনোটি ফোটার অপেক্ষায় গোল হয়ে আছে। অচিরেই কুঁড়িগুলো ঘোমটা খুলে ফুল হয়ে মাধুর্যের ফণা তুলবে। গাছটির একেবারে নিচ থেকে ওপরের শাখা-প্রশাখা পর্যন্ত ফুল ফুটেছে, একটুও ফাঁক নেই। পাতাই দেখা যায় না, এত ফুল! গাছ থেকে চোখ ফেরানোর উপায় নেই। ‘চোখ না ফেরালে...অনন্তকাল থাকিতে যে হবে এই বনে’—এমন একটা অবস্থা। গাছের নিচে ঝরে পড়েছে ফুলের অসংখ্য পাপড়ি। গাছের নিচটুকু ফুল আঁকা রঙিন চাদরের মতো হয়ে আছে। অনেকে ফুল দেখতে ভিড় করছেন এই বাড়িতে। অনেকের কাছেই নাগলিঙ্গম নতুন এক বিস্ময়ের ফুল।

একটিমাত্র বৈশিষ্ট্যে নাগলিঙ্গম অন্য গাছপালা থেকে স্বতন্ত্র, কাণ্ড থেকে ঝুলন্ত মঞ্জরি এবং উজ্জ্বল বিরাট ফুল ও ফলের প্রাচুর্য
ছবি: প্রথম আলো

সংস্কৃতিকর্মী সালেহ এলাহী বলেন, ‘এ অঞ্চলে (বৃহত্তর সিলেট) হাতে গোনা দু-তিনটি নাগলিঙ্গমগাছ আছে। এই বাড়ির গাছটি আমি আগেও দেখেছি। তবে এবার মনে হচ্ছে অনেক বেশি ফুল ফুটেছে। গাছের বাকল দেখা যায় না, শুধু ফুল আর ফুল।’

নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইয়ে নাগলিঙ্গম সম্পর্কে জানিয়েছেন, এ গাছের আদি আবাস দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণ মণ্ডলে। এত দূরদেশ থেকে এ দেশে এর আমদানি কবে-কখন ঘটেছিল, আজ তা জানা অসম্ভব। গাছটি প্রায় চিরহরিৎ। গ্রীষ্ম হচ্ছে পত্রমোচনের কালো। কিন্তু বছরে কয়েকবারই পাতা ঝরে, নতুন পাতা গজায়।

একটিমাত্র বৈশিষ্ট্যে নাগলিঙ্গম অন্য গাছপালা থেকে স্বতন্ত্র, কাণ্ড থেকে ঝুলন্ত মঞ্জরি এবং উজ্জ্বল বিরাট ফুল ও ফলের প্রাচুর্য। প্রায় মাটির কাছ থেকে বহু উঁচু অবধি কাণ্ড মঞ্জরির প্রাচুর্যে আচ্ছন্ন থাকে। প্রস্ফুটিত এ তরু বর্ণে, গন্ধে, উজ্জ্বলতায় তরুরাজ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নাগলিঙ্গমের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো সাপের ফণার মতো বাঁকানো উদ্যত পরাগচক্র। ঠিক এমনটি এ দেশের অন্য কোনো ফুলে নেই। প্রায় সারা গ্রীষ্মেই ফুল ফোটে। বর্ষা ও শরতে ফুল ফোটার প্রাচুর্য কমে এলেও একেবারে শেষ হয়ে যায় না।

বাড়ির মালিক দেওয়ান গউছউদ্দিন আহমদ বলেন, গাছটি প্রায় ১৫-১৬ বছর ধরে ফুল দিচ্ছে। এবার অনেক ফুল ফুটেছে। এত ফুল আগে ফোটেনি। প্রথম যখন ফুল ফোটে, কী ফুল, তাঁরা চিনতে পারেননি। পরে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে চিনতে পেরেছেন, এটা নাগলিঙ্গম।