‘৫০ বছর ধরে এখানে আছি। আমরা মাথায় করে মাটি এনে জায়গা ভরাট করেছি। অনেক কষ্ট করে ঘর উঠিয়েছি। উচ্ছেদ হলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? রাস্তায় থাকা ছাড়া উপায় নেই।’ কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন দুলিয়া বেগম। তিনি খুলনা নগরের খালিশপুর বাস্তুহারা কলোনি এলাকার বাসিন্দা। কলোনির যে অংশে তিনি ঘর করে থাকেন, স্থানীয় বাসিন্দারা সেটাকে ‘মুক্তিযোদ্ধা কলোনি নামে’ পরিচয় দেয়। সেখানে প্রায় দেড় শ বাড়িতে হাজারখানেক মানুষের বাস।
৭ ডিসেম্বর গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ এলাকায় মাইকিং করে উচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছে। ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে নিজ উদ্যোগে বসতবাড়ি ও মালামাল সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে।
কলোনির আরেকজন বাসিন্দা আবদুল মান্নান বলেন, ‘এখন আমরা কোথায় যাব? মরা ছাড়া কোনো উপায় নাই। মাইকিংয়ের পর থেকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেছি, কাঁদতেছি, রান্না নাই, খাওয়া নাই। কী করব, কী হবে! উচ্ছেদ যখন করেই দেবে, তখন একটা পথ করে দিক, যেন দাঁড়ানোর একটা জায়গা পাই।’
মো. রাসেল নামের কলোনির আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদের বাপ-দাদা এই জায়গায় মারা গেছে। একটা ঘর সরিয়ে নিতে গেলেও তো সময় লাগে। আমরা এখানে সবাই অসহায়। রোহিঙ্গারা যদি এ দেশে জায়গা পায়, আমরা এ দেশের নাগরিক হয়ে কেন ঘরে থাকতে পারব না? কেন আমাদের জন্য জায়গা থাকবে না! আমরা তাহলে যাব কোথায়?’
তবে কলোনির শুধু ওই অংশই নয়। উচ্ছেদের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বাস্তুহারাজুড়ে। কলোনির অন্য অংশের বাসিন্দারা মনে করছেন, হয়তো ধাপে ধাপে তাঁদেরও উচ্ছেদ করা হবে।
গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বাস্তুহারা নামে পরিচিত ওই এলাকা তাদের কাছে ‘বয়রা আবাসিক এলাকা’। সেখানে প্রায় ৩০ একর জায়গা রয়েছে। এর মধ্যে সি-ব্লকে তাদের ৫৫টির মতো প্লট আছে। যেগুলো ১৯৮৭ সালে স্থায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৪২টি প্লট বেদখল হয়ে থাকায় ৩৭ বছর ধরে তারা প্রকৃত মালিকদের বুঝিয়ে দিতে পারেননি। বিভিন্ন সময় ৪ দফায় উচ্ছেদ করতে গেলেও রাজনৈতিক কারণে দখলদারদের সরানো যায়নি। বিভিন্ন সরকারের আমলে মন্ত্রী, মেয়র, প্রভাবশালী নেতারা উচ্ছেদপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করেছেন। আগামীকাল বুধ ও পরদিন বৃহস্পতিবার ওই ৪২টি প্লটের জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান চালাবে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ।
গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলেন, সি-ব্লকের পাশে ১৯৭২ সালের দিকে ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসনের জন্য ৪৫০ বর্গফুট করে ৭১৩টি প্লট (১ থেকে ১১ নম্বর রোড) অস্থায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়। স্থায়ী বরাদ্দ দেওয়া না হলেও ওই অংশকে অবৈধ বলছে না কর্তৃপক্ষ। গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ সেই অংশে কোনোরকম উচ্ছেদ চালাবে না। এই ৭১৩টি প্লটের পাশে আরও সাড়ে ৯ একর জায়গায় আছে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের, সেটা নীল বস্তি নামে পরিচিত। সেখানেও অবৈধ দখলদার আছেন। তবে সেই অংশ আগে সার্ভে করে উন্নয়নের পর বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা আছে তাঁদের। ওই অংশও এখনই উচ্ছেদের কোনো পরিকল্পনা তাঁদের নেই।
গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জিয়াউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ সারা দেশেই অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে অভিযান চালাচ্ছে। বয়রা আবাসিক এলাকার সি-ব্লকের ৪২টি প্লট দখলদারের দখলে। আগে অনেকবার চেষ্টা করেও দখলদার উচ্ছেদ করে প্লট বুঝিয়ে দেওয়া যায়নি। গত ২৭ নভেম্বরের মধ্যে তাঁদের জায়গা ছাড়ার কথা বলা হলেও তাঁরা ছাড়েনি। পরে আবার সময় বাড়িয়ে ১১ ডিসেম্বর করা হয়েছে। ওই এলাকার অন্য অংশ নিয়ে তিনি বলেন, যে ৭১৩টি ছোট প্লট অস্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো উচ্ছেদের সম্ভাবনা নেই।