ঠাকুরগাঁও জেলা শহর
দিনরাত উচ্চ শব্দে মাইকিং
৬০ ডেসিবেল শব্দের তীব্রতায় মানুষ সাময়িক বধির এবং ১০০ ডেসিবেল শব্দের তীব্রতায় স্থায়ী বধির হয়ে যেতে পারে।
‘সুখবর! সুখবর! সুখবর! মাংসপ্রিয় ভোজনবিলাসীদের জন্য সুখবর। আগামীকাল সকালে...মাংসের দোকানে একটি উন্নত মানের মহিষ জবাই করা হবে। মহিষটির মূল্য ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আগে আসলে আগে পাবেন।’
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জগদীশ চন্দ্র রায় বলেন, ‘সকাল থেকেই মাইকে সুখবরের প্রচার শুরু। সুখবরে কান ঝালাপালা অবস্থা। এই সুখবরের যন্ত্রণা থেকে আমরা মুক্তি চাই।’
ঠাকুরগাঁও জেলা শহরে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রতিদিন উচ্চ শব্দে মাইক বাজিয়ে রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনের কর্মসূচি, ভোগ্যপণ্য, ভাঙারি পণ্য কেনা, গরু-ছাগল হারানোসহ নানা প্রচারণা চালানো হয়। ফলে সড়কের পাশে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, হাসপাতাল, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বিমার দাপ্তরিক কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। মাইকের আওয়াজে শিক্ষার্থীরা রাতের বেলায় পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারে না।
সম্প্রতি শহরের সরকারপাড়া মহল্লার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সিনথিয়া শারমিন সম্প্রতি জানায়, ‘এখন পরীক্ষা চলছে। দিনের বেলার কথা বাদ দেন, রাতের বেলায়ও মাইকের আওয়াজে পড়ায় মনোযোগ দেওয়া যায় না।’
চৌরাস্তার ব্যবসায়ী দুলাল হোসেন বলেন, শহরে উচ্চ শব্দে রাত-দিন মাইকিং চলছে। মাইকের আওয়াজে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। সঙ্গে আছে গাড়ির হর্ন।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫–এর ক্ষমতাবলে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালায় ‘নীরব’, ‘আবাসিক’, ‘মিশ্র’, ‘বাণিজ্যিক’ ও ‘শিল্প’—এ পাঁচটি এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বিধিমালার আওতায় নীরব এলাকায় দিনে (ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা) ৫০ ডেসিবেল ও রাতে (রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা) ৪০ ডেসিবলের বেশি আওয়াজ করা যাবে না। একইভাবে আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ ও রাতে ৪৫ ডেসিবেল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ও রাতে ৫০ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ও রাতে ৬০ ডেসিবেল এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ও রাতে ৭০ ডেসিবেল শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
শহরের বঙ্গবন্ধু সড়ক, শহীদ মোহাম্মদ আলী সড়ক, সিরাজউদ্দৌলা সড়ক, নরেশ চৌহান সড়ক, নর্থ সার্কুলার সড়ক, কলেজপাড়া, হাজিপাড়া, পুরোনো বাসস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন এলাকার ১২ জন বাসিন্দা বলেন, মিশ্র বা বাণিজ্যিক এলাকা ধরে যদি তাঁদের এলাকায় শব্দ মাপা হয়, তারপরও তা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি আসবে।
সম্প্রতি শহরের শহীদ মোহাম্মদ আলী সড়কে উচ্চ শব্দে মাইক বাজিয়ে এনার্জি সেভার বৈদ্যুতিক বাতি বিক্রি করছিলেন মো. শামীম। তিনি বলেন, ‘লোকজনের উপকারের জন্য বাল্ব বিক্রি করি। ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে মাইক বাজাতে হয়। সবাই তো মাইক বাজাচ্ছে, তাই আমরাও বাজাচ্ছি।’ বাল্ব বিক্রির জন্য মাইক বাজাতে প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাইক বাজাতে অনুমতি নেওয়া লাগে, এই প্রথম শুনলেন।
সম্প্রতি বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল এলাকার ৫০০ মিটারের মধ্যে মাইকে ৭ জায়গায় মাইকিং করতে দেখা গেছে। ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শেখ মাসুদ বলেন, সাধারণত ৬০ ডেসিবল শব্দের তীব্রতায় মানুষ সাময়িক বধির এবং ১০০ ডেসিবল শব্দের তীব্রতায় স্থায়ী বধির হয়ে যেতে পারে। মাইকিংয়ের শব্দ মানুষের মস্তিষ্কে আঘাত করে। এতে শ্রবণশক্তি হ্রাস ছাড়াও হৃদ্রোগের ঝুঁকি থাকে। তবে শব্দদূষণের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। শব্দদূষণ তিন বছর বা তার কম বয়সী শিশুদের মানসিক বিকাশের অন্তরায়।
পরিবেশ অধিদপ্তর পঞ্চগড় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ইউসুফ আলী জানান, কোনো ব্যক্তি আইন লঙ্ঘন করে দোষী সাব্যস্ত হলে প্রথম অপরাধের জন্য এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। কিন্তু অধিদপ্তরে লোকবল কম। এর অভাবে জেলা পর্যায়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে পারেন না তাঁরা।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বলেন, অনুমতির বিধান থাকলেও শহরে মাইকিংয়ের জন্য তাঁদের কাছে কেউ আসেন না। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।