নদীপাড়ের মাটি–বালু লুট

নিলামের শর্ত ভঙ্গ করে নদীপাড়ের মাটি কেটে নিচ্ছেন আওয়ামী লীগের এক নেতা। তাগাদা দিলেও তিনি নিলামের টাকা পরিশোধ করছেন না।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাড় ঘেঁষে নদী থেকে তোলা হচ্ছে বালু ও মাটি। গত বুধবার দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার পাল্টাপুর ইউনিয়নে।
ছবি: প্রথম আলো

দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) আওতায় ঢেপা নদী খননের বালু নিলামে সর্বোচ্চ দরদাতা হয়ে বিক্রির অনুমতি পেয়েছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় একজন নেতা। কিন্তু নিলামের আংশিক টাকা পরিশোধ ও শর্ত ভঙ্গ করে তিনি বালু ও মাটি তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। উপজেলা প্রশাসন ও পাউবোর কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এই বালু-মাটি বিক্রি করছেন তিনি।

নিলামের চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সীমানার বাইরে গিয়ে বালু-মাটি তুলে নেওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে নদীপাড়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পের শতাধিক পরিবার। তাঁরা বাধা দিতে গেলে পুলিশ ও মামলার ভয় দেখাচ্ছেন ওই আওয়ামী লীগ নেতা। এ ছাড়া পাউবো থেকে একাধিকবার টাকা পরিশোধের তাগাদা দিলেও তিনি কর্ণপাত করছেন না।

ওই আওয়ামী লীগ নেতার নাম তোফাজ্জাল হোসেন। তিনি পাল্টাপুর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য। ২০১৮ সালে পাল্টাপুর ইউনিয়ন পরিষদের উপনির্বাচনে নৌকা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি হেরে যান। পরাজিত হলেও এলাকায় তিনি চেয়ারম্যান হিসেবেই পরিচিত। বালু বিক্রির অনুমতি নিয়ে নদীপাড়ের মাটি কাটার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। এর আগে ঢেপা নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে নিলাম ছাড়াই নদীর পূর্ব পাড়ের বালু বিক্রি করেন তোফাজ্জাল। গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে ‘নদীতে বাঁধ দিয়ে বালু বিক্রি’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সেই অংশে বালু উত্তোলন বন্ধ করেন তিনি।

পাউবো কার্যালয় সূত্র জানায়, ‘দিনাজপুর শহর রক্ষা প্রকল্পের পুনর্বাসন এবং শহরসংলগ্ন ঢেপা ও গর্ভেশ্বরী নদী সিস্টেম ড্রেজিং/খনন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ঢেপা ও গর্ভেশ্বরী নদীর ৯ দশমিক ৪ কিলোমিটার ১৮ কোটি ১৮ লাখ ২২ হাজার টাকা ব্যয়ে পুনঃখনন করা হয়। গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া কাজ চলতি বছর জুনে শেষ হয়। ঢাকার তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খননকাজ করে। চুক্তি অনুযায়ী খনন করা বালু নদীর দুই ধারে স্তূপ করে রাখে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেই বালু নিলামে বিক্রি করেছে পাউবো। তোফাজ্জাল প্রথমে অবৈধভাবে বালু বিক্রি শুরু করেন। বিষয়টি আলোচনায় এলে গত ৩১ জানুয়ারি পাউবো কর্তৃপক্ষ তোফাজ্জালের বিরুদ্ধে বালু চুরির অভিযোগ তুলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) লিখিতভাবে জানায়। কিন্তু কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং জুন মাসে নদীর পশ্চিম পাড়ের বালুর নিলাম হলে সর্বোচ্চ দরদাতা হয়ে বালু বিক্রির অনুমতি পান তিনি।

গত বৃহস্পতিবার ঢেপা নদীর পাড় ও তৎসংলগ্ন রামপুর এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, নদীর ভাদগাঁ সেতু ঘেঁষে নদীর উত্তর-দক্ষিণ পাড়ে নতুন করে রাস্তা বানানো হয়েছে। খননযন্ত্র দিয়ে ডাম্পট্রাক ও অন্যান্য পরিবহনে বালু তুলে দিনাজপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে খননের বালু তোলা শেষ হয়েছে। এখন নদীপাড়ের মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। নদীপাড় থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরত্বে আশ্রয়ণের ঘর।

আশ্রয়ণের বাসিন্দা পবিত্র সরকার বলেন, ‘কাকে বলব, কেউ কথা শোনে না। সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখে ইউএনও অফিসে অভিযোগ দিয়েছি। কোনো গুরুত্ব নাই। তোফাজ্জালকে বাধা দিলে তিনি বলেন, টাকা দিয়ে ঘাট নিয়েছেন। প্রশাসনকে নাকি নিয়মিত টাকা দেন। আমরা কার কাছে বিচার দেব। এবারের বর্ষাটা না হয় শেষ। ভবিষ্যতে ঠিকমতো বর্ষা হলে আশ্রয়ণের ঘর, মন্দিরসহ সব নদীতে তলিয়ে যাবে।’

পাউবোর দিনাজপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিুবল ইসলাম বলেন, পাল্টাপুরের ওই এলাকায় খননের বালু নিলাম হয়েছে। তাঁরা শুধু তালিকা ও বালুর পরিমাণ হিসাব করে দেন। পরবর্তী বিষয়গুলো দেখভালের দায়িত্ব প্রশাসনের। সাধারণত নিলাম হওয়ার তিন দিনের মধ্যে ভ্যাট-ট্যাক্সসহ সরকারি কোষাগারে টাকা জমা দেওয়ার নিয়ম। তোফাজ্জাল সেই নিয়ম ভঙ্গ করেছেন। ইতিমধ্যে টাকা পরিশোধের জন্য তাঁকে চারবার চিঠি দেওয়া হয়েছে।

তোফাজ্জাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পারিবারিক সমস্যার কারণে পাউবোর টাকা পরিশোধ করতে দেরি হয়েছে। কিস্তিতে তিনি সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করবেন। নদীপাড়ের কোনো মাটি কাটা হচ্ছে না। বিরোধী পক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল।