সাত মাস পর মায়ের কোলে ফিরল হাসপাতাল থেকে চুরি হওয়া শিশু

হাসপাতাল থেকে চুরি হয়ে যাওয়া শিশুকোলে মা আয়েশা আক্তার। পাশে বাবা জসিম উদ্দিন। মঙ্গলবার দুপুরে কুমিল্লা পিবিআই দপ্তরেছবি: প্রথম আলো

প্রায় সাত মাস ধরে আয়েশা আক্তার কাঁদছেন। প্রতিদিন নামাজের বিছানায় সন্তানকে ফিরে পেতে প্রার্থনা করতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, একদিন সন্তানকে ফিরে পাবেন। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কুমিল্লার সদস্যরা আয়েশার মেয়েকে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে পিবিআই কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার বারপাড়া গ্রামের আয়েশা আক্তারের কোলে তাঁর শিশুকে দেন। সন্তানকে কাছে পেয়ে মায়ের চোখে আনন্দাশ্রু। বুকে জড়িয়ে নিলেন পরম মমতায়। কপালে গালে চুমু দিয়ে অপত্য স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেন। শিশুটিকে চুরির ঘটনায় দুই নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

পিবিআই কুমিল্লার পরিদর্শক মফজল আহমদ খান জানান, গত বছরের ১০ আগস্ট কুমিল্লা নগরের জেনারেল হাসপাতালে আয়েশা আক্তার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কন্যাশিশুর জন্ম দেন। ১৩ আগস্ট নবজাতকটিকে নিয়ে তাঁর নানি নুরজাহান বেগম হাসপাতালের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করেন। ওই সময় তাঁদের পরিচিত পারভীন আক্তার নামের এক নারী নবজাতককে চিকিত্সকের কাছে নিয়ে যান। হাসপাতালের কাউন্টারের সামনে তাঁর কাছ থেকে নবজাতককে কোলে তুলে নেন অজ্ঞাত এক নারী। এরপর ওই নারী নবজাতকটিকে নিয়ে পালিয়ে যান। পরে জানা যায়, ওই নারীর নাম জেসমিন আক্তার। কিন্তু তাঁর ও নবজাতকের খোঁজ মিলছিল না।

এ ঘটনায় আয়েশা আক্তারের স্বামী মো. জসিম উদ্দীন বাদী হয়ে কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় মানব পাচার আইনে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ মামলার তদন্ত করেন কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মফিজুর রহমান। মফিজুর চার মাসেও এই মামলার কোনো কিনারা করতে পারেননি। পরে আদালত মামলাটি পিবিআই কুমিল্লাকে তদন্ত করার নির্দেশ দেন।

পিবিআই কুমিল্লার পরিদর্শক মফজল আহমদ জানান, গত সোমবার বেলা ২টা ০৫ মিনিটে রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে বাচ্চাসহ জেসমিন আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেসমিনের বাড়ি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের পূর্ব পদুয়া গ্রামে। জেসমিনের স্বামীর বাড়ি বগুড়ায়। জেসমিন কুমিল্লা ইপিজেড–সংলগ্ন ইয়াছিন মার্কেট এলাকায় থাকেন।

পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে জেসমিন জানান, তাঁর কোনো ছেলে নেই। হাসপাতাল থেকে পারভীনের কাছ থেকে ছেলে শিশু ভেবে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে নবজাতকটিকে কিনে নেন জেসমিন। বাসায় নেওয়ার পর দেখতে পান মেয়েশিশু। ওই কারণে পারভীনকে ৩০ হাজার টাকা দেন। ছেলে বাচ্চা না হওয়ায় আর টাকা দেননি।

জেসমিন আক্তার বলেন, ‘আমি কোনো মানব পাচার দলের সদস্য না। আমি ছেলে ভেবে এতিম মনে করে শিশুটিকে পারভীনের কাছ থেকে কিনে নিই। পরে বাসায় গিয়ে দেখি মেয়েশিশু। এখন তো আমি ওকে ফেলে দিতে পারি না। আমি তার নাম রাখি জান্নাত। তাঁকে যত্ন করে বড় করেছি।’

এ ঘটনায় পারভীন আক্তারকেও সোমবার রাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁর স্বামীর বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার নিয়ামতপুর গ্রামে। পারভীন বলেন, ‘আমি জানি না কোথা থেকে কী হয়েছে।’

মঙ্গলবার বিকেলে গ্রেপ্তার দুই নারীকে কুমিল্লার আদালতে নেওয়া হয়। সেখানে ১৬৪ ধারায় তাঁদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নেওয়া হয়। পরে তাঁদের কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।

দুপুরে শিশুটিকে মা আয়েশা আক্তার পিবিআই কুমিল্লার হাউজিং এস্টেট দপ্তরের দ্বিতীয় তলায় ফিডার দিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। কতক্ষণ পরপর এ–গালে ও–গালে চুমু খাচ্ছিলেন। তাঁর দুই চোখ বেয়ে জল পড়ছিল। কেবলই কাঁদছিলেন। এ প্রতিবেদককে আয়েশা বলেন, ‘আমার বিশ্বাস ছিল, ওকে ফিরে পাবই। পুলিশকে ধন্যবাদ। আমি বিচার চাই তাঁদের, যাঁদের কারণে আমার সাত মাস ধরে চোখের জল ধরেছে।’

শিশুটির বাবা মো. জসিম উদ্দীন বলেন, ‘আমার এক মেয়ে, এক ছেলে।ছেলেটি বড়। হাসপাতাল থেকে চার দিনের শিশুকে চুরি করে নেওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও দায় এড়াতে পারে না। আমি আমার সন্তানের নাম দিলাম সুফিয়া।’

পিবিআই কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংরক্ষণ করতে হবে। দালাল ঠেকাতে হবে। নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। হাসপাতাল থেকে চার দিনের বাচ্চা চুরি হওয়ার পর তাঁকে খুঁজে বের করেছে পিবিআই।’