বালু তোলায় হুমকিতে সুন্দরবন

খুলনার কয়রা উপজেলার হরিহরপুর লঞ্চঘাটসংলগ্ন এলাকা থেকে জোড়শিং পর্যন্ত চার কিলোমিটার থেকে বালু তোলা হয়।

খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন শাকবাড়িয়া নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু তোলা হয়। সম্প্রতি তোলা ছবি
প্রথম আলো

পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া নদী থেকে কয়েকটি ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে। আইন অনুযায়ী এভাবে বালু তোলা নিষিদ্ধ। অথচ সরকারি বাঁধ নির্মাণের কাজেই এই বালু ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এই বালু তোলা হচ্ছে সুন্দরবনের নদীর ভাঙনকবলিত এলাকা থেকে। এই ব্যাপারে জেলা প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বালু তোলা অব্যাহত থাকায় ওই এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী।

এই কাজ তদারকির দায়িত্বে রয়েছে পাউবো সাতক্ষীরা-২ বিভাগ। সেখানকার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসিকুর রহমান বলেন, ‘ভাঙনের পাশ থেকে বালু তুললে তা এখনই বন্ধ  করার ব্যবস্থা নিচ্ছি। একই সঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছেও কৈফিয়ত তলব করা হবে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, খুলনার কয়রা উপজেলায় পাউবোর ১৪/১ পোল্ডারের হরিহরপুর এলাকায় এম এম বিল্ডার্স, আমীর ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নামের তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রায় দুই কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের নদীতীর রক্ষা কাজ করছে। এ কাজের জন্য প্রায় এক শ কোটি টাকা চুক্তি মূল্যে ধরা হয়েছে।

প্রতিদিন সুন্দরবনের নদীর ভাঙনকবলিত স্থান থেকে কয়েক হাজার ঘনফুট বালু তুলে উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের হরিহরপুর বেড়িবাঁধের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় ড্রেজারমালিকের সঙ্গে চুক্তি করে এভাবে এক মাস ধরে বালু তুলছেন।

অথচ বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ধারা ৫-এর ১ উপধারা অনুযায়ী, পাম্প বা ড্রেজিং বা অন্য কোনো মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। ধারা ৪-এর (খ) অনুযায়ী, সেতু, কালভার্ট, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ। আইন অমান্যকারী দুই বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টায় সরেজমিনে দেখা যায়, শাকবাড়িয়া নদীর পূর্ব পাশে সুন্দরবন এবং পশ্চিম পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ভাঙনকবলিত বাঁধ। উপজেলার হরিহরপুর লঞ্চঘাটসংলগ্ন এলাকা থেকে জোড়শিং এলাকার সুন্দরবনের বজবজা বন টহল ফাঁড়ির মধ্যবর্তী শাকবাড়িয়া নদীর চার কিলোমিটার এলাকার মধ্য থেকে প্রতিদিন ১৫–২০ হাজার ঘনফুট বালু তোলা হচ্ছে।

কার্গোতে তুলে ওই বালু নদীর কিনারে এনে বস্তায় ভরছেন শ্রমিকেরা। সেই বস্তা গণনা শেষে আবারও নদীর মধ্যেই ফেলা হচ্ছে। সেখানে কাজ তদারকির জন্য পাউবোর কোনো কর্মকর্তাকে দেখা যায়নি। ভাঙনকবলিত উপকূল রক্ষা বাঁধ সংস্কারের জন্য পাশের নদী থেকে বালু তোলার ঘটনায় আপত্তি জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।

এ বিষয়ে স্থানীয় কয়েকজন বলেন, বাঁধ মেরামতের জন্য ভাঙনপ্রবণ এলাকা থেকে বালু তোলায় ওই এলাকা নদীভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হলে কয়েক দিন আগে ওই এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। ওই সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত একটি ড্রেজারের মালিককে জরিমানা করা হয়। এর দুই দিন পরেই আবার বালু তোলা শুরু করেন তাঁরা। দিনের চেয়ে রাতের বেলা বেশি বালু তোলা হয় বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় লোকজন।

হরিহরপুর গ্রামের বাসিন্দা বনমালা মন্ডল বলেন, প্রতি রাতেই সেখানকার বাঁধের কোনো না কোনো স্থানে ধস পড়ছে। সুন্দরবনের পাশ থেকে বালু তোলায় সেখানেও ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। শুধু অধিক মুনাফার লোভে ভাঙনকবলিত এলাকার নদী থেকে বালু তোলা হচ্ছে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য হরষিত মন্ডল বলেন, সুন্দরবনের শাকবাড়িয়া নদীর যে অংশ থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে, তার পাশে অতীতেও একাধিকবার ভাঙনের ঘটনা ঘটেছে। যেখানে ভাঙনের তীব্রতা বেশি, সেখান থেকেই বালু তুলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছেন ঠিকাদার। একই সঙ্গে সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে ফেলছে। ঠিকাদারের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ সরকারের বড় একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

বালু উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত মো. হারুনর রশীদ বলেন, এখানে বালু সরবরাহের জন্য মোট সাতটি ড্রেজার রয়েছে। এর মধ্যে আমার চারটি ছাড়াও পাইকগাছার আপিল, কয়রার সৌরভ ও গণেশ চন্দ্র মন্ডলের একটি করে ড্রেজার রয়েছে। তবে অন্যরা সুন্দরবন ও বাঁধের মধ্যবর্তী নদী থেকে বালু উত্তোলন করলেও তিনি দূর থেকে বালু আনছেন।

অবৈধভাবে বালু তোলার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম এম বিল্ডার্সের পক্ষে আবদুল আজিজ বলেন, ‘আমরা ভাঙনকবলিত জায়গা বালু তোলার জন্য কাউকে বলিনি। অনেকেই কাজের সাইটে বালু দেওয়ার জন্য চুক্তি করেছেন। তাঁরা কোথা থেকে বালু তুলছেন, তা আমাদের জানার কথা নয়।’

সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র জানান, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে যেকোনো এলাকার জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে পারে। এমনিতেই সুন্দরবনের আয়তন ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। তার ওপর সুন্দরবনের আশপাশ থেকে বালু তোলার বিষয়টি রীতিমতো আত্মঘাতী হওয়ার মতো ঘটনা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, ‘সুন্দরবনসংলগ্ন নদী থেকে বালু তোলা বনের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। ওই এলাকা থেকে বালু তোলা বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসিন আরেফিন বলেন, কয়রা উপজেলার কোনো নদী থেকে বালু তোলার অনুমতি নেই। কারণ, উপকূলীয় ওই এলাকাটি নদীভাঙন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এর আগেও ওই এলাকায় বালুদস্যুদের জরিমানা করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।