মুখোমুখি সংঘর্ষ থেকে যেভাবে রক্ষা পেল দুটি ট্রেন

দোহাজারী-কক্সবাজার পথে ট্রেনফাইল ছবি

দুই ট্রেনচালকের সতর্কতায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ও পর্যটক এক্সপ্রেস। স্টেশনমাস্টার ট্রেন চলাচলে ভুল সংকেত দেওয়ায় দুটি ট্রেন একই লাইনে বিপরীত দিক থেকে চলতে শুরু করে। কিন্তু দুই ট্রেনচালকের উপস্থিত বুদ্ধি ও নিজেদের মধ্যে আলাপের কারণে শেষ পর্যন্ত দুর্ঘটনা ঘটেনি। মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে জানমালসহ ট্রেনের ভয়াবহ ক্ষতি হতো বলে জানান রেলের কর্মকর্তারা। ভুল সংকেত দেওয়ায় কক্সবাজারের চকরিয়া স্টেশনমাস্টার আজিম উদ্দিনকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার (ক্লোজড) করা হয়েছে।

স্টেশনমাস্টারের ভুলে গত শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের লোহাগাড়া থেকে চকরিয়া অংশে এ দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। কক্সবাজার এক্সপ্রেস কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাচ্ছিল। আর পর্যটক এক্সপ্রেস ছিল ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী। দুই ট্রেনেই প্রায় সাড়ে সাত শ থেকে আট শ করে যাত্রী ছিল।

স্টেশনমাস্টারের ভুল সংকেতের কারণে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা ছিল বলে জানান রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্টেশনমাস্টার ভুল সংকেত দিলেও লোকোমাস্টারসহ (ট্রেনচালক) অন্যরা তা দ্রুত বুঝতে পারেন। এ জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ফলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। দায়িত্বে অবহেলায় চকরিয়ার স্টেশনমাস্টারকে ক্লোজড (প্রত্যাহার) করা হয়েছে।

তবে দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন স্টেশনমাস্টার আজিম উদ্দিন। তিনি দাবি করেন, যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে, বিষয়টি সে রকম নয়। কোনো দুর্ঘটনা ঘটত না।

রেলের কর্মীদের ভুলে প্রতিবছরই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। গত পাঁচ বছরে বড় ধরনের পাঁচটি ট্রেন দুর্ঘটনায় অন্তত ৩৮ জন মারা যান। এসব দুর্ঘটনা তদন্তে রেলের কর্মীদের গাফিলতির বিষয়টি উঠে আসে। সর্বশেষ শুক্রবার সকালে ফেনীতে রেলক্রসিং পারাপারের সময় একটি ট্রাকের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। ফেনীর ফাজিলপুর রেলস্টেশন ও মুহুরীগঞ্জ রেলস্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে। রেলক্রসিংটিতে ট্রেন আসার আগে ব্যারিয়ার (প্রতিবন্ধক) ফেলা হয়নি। সেখানে নিয়োজিত গেটম্যান সাইফুল ইসলাম দায়িত্বরত ছিলেন না।

মুখোমুখি সংঘর্ষ থেকে যেভাবে রক্ষা

রেলওয়ের কর্মকর্তা, স্টেশনমাস্টার ও লোকোমাস্টারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী কক্সবাজার এক্সপ্রেস চকরিয়া স্টেশনে এসে পৌঁছায় বেলা ১টা ২২ মিনিটে। চকরিয়া স্টেশনমাস্টার আজিম উদ্দিন কক্সবাজার এক্সপ্রেসকে চকরিয়া থেকে লোহাগাড়া যাওয়ার জন্য সংকেত দেন। যদিও চকরিয়া স্টেশন থেকে হারবাং স্টেশন পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার কথা ছিল। অন্যদিকে লোহাগাড়া স্টেশনমাস্টার পর্যটক এক্সপ্রেসকে লোহাগাড়া থেকে হারবাং স্টেশন পর্যন্ত যাওয়ার জন্য সংকেত দেন। রেলওয়ের পাহাড়তলী নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকেও দুই ট্রেনকে নির্ধারিত স্টেশনে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

নিয়ন্ত্রণকক্ষ ও দুই স্টেশনমাস্টারের সংকেত পেয়ে দুই ট্রেনের লোকোমাস্টার (ট্রেনচালক) ট্রেন চালাতে শুরু করেন। তবে পর্যটক এক্সপ্রেসের লোকোমাস্টার মোহাম্মদ গোলাম রসুল কক্সবাজার এক্সপ্রেসের লোকোমাস্টার মো. জাহেদুল ইসলামকে মুঠোফোনে কল করে ট্রেন কোথায় আছে জানতে চান। তখন জাহেদুল ইসলাম জানান, তিনি ট্রেন নিয়ে চকরিয়া থেকে লোহাগাড়ার দিকে রওনা দিয়েছেন। একইভাবে মোহাম্মদ গোলাম রসুলও জানান, তিনিও ট্রেন নিয়ে লোহাগাড়া থেকে হারবাং স্টেশনে যাচ্ছেন।

ট্রেনের অবস্থান জানতে পেরে দুই লোকোমাস্টারই বুঝতে পারেন, বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।

কেননা, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে একটি মাত্র লাইন আছে। যদি তাৎক্ষণিকভাবে ট্রেন থামানো না হয়, তাহলে মাঝপথে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটবে। তখন দুই ট্রেনের গতি ছিল ৫০ কিলোমিটার। তাঁরা দ্রুত পাহাড়তলীর নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে দুই ট্রেনকেই থামার নির্দেশ দেওয়া হয়।

পর্যটক এক্সপ্রেসের লোকোমাস্টার মোহাম্মদ গোলাম রসুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নিয়ন্ত্রণকক্ষ ও স্টেশনমাস্টারদের সংকেত ও নির্দেশনা অনুযায়ী ট্রেন চালিয়ে থাকি। কিন্তু ওই দিন কী মনে করে কক্সবাজার এক্সপ্রেসের লোকোমাস্টার জাহেদকে (মো. জাহেদুল ইসলাম) মুঠোফোনে কল দিই। তখন কোন স্টেশনে আছে, কোথায় ক্রসিং হবে এগুলো জানতে চাই। এরপর জাহেদ জানান, লোহাগাড়ার দিকে আসছে। আমিও জানাই। এই খবর শুনে টেনশনে পড়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এরপর ট্রেন থামিয়ে দিই। ওদিক দিয়ে জাহেদও ট্রেন থামিয়ে দেন। যদি ফোন না করতাম তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেত। এক ফোনের কারণে বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি আমরা।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ১১ নভেম্বর দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মিত নতুন রেললাইনের উদ্বোধন করেন। আর ট্রেন চলাচল শুরু হয় গত বছরের ১ ডিসেম্বর। এই ট্রেনের নাম কক্সবাজার এক্সপ্রেস। এরপর ১০ জানুয়ারি থেকে পর্যটক এক্সপ্রেস নামের আরেকটি বিরতিহীন ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।