কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কলাতলী পয়েন্ট। আজ বুধবার সকাল ১০টা। ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে লন্ডভন্ড সৈকতে পর্যটকের তেমন সমাগম নেই। হাতে গোনা কয়েকজন পর্যটক হাঁটুপানিতে নেমে লোনাজলে শরীর ভেজাচ্ছেন। বালুচরে একটি ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে কিশোর ঈমাম হোসেন। ঘোড়ার পিঠে চড়ার জন্য সে পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল, কিন্তু সেদিকে কারও আগ্রহ নেই।
ঈমাম হোসেন (১৭) আক্ষেপের সুরে বলে, ভাঙা সৈকতে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘোরার জায়গা নেই। কলাতলী থেকে লাবণী পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সৈকতের ১২টি জয়গায় ভাঙা। কয়েকটি ভাঙা অংশ সমুদ্রসৈকতে দ্বিখণ্ডিত করে রেখেছে। তাই কেউ ঘোড়ার পিঠে চড়তে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। সকাল সাতটা থেকে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করেও একজন লোক পাওয়া গেল না ঘোড়ার পিঠের চড়ার জন্য। আয়রোজগার না হলে পেটে খাবারও জোটে না।
পাশের সুগন্ধা সৈকতে ঘোড়া নিয়ে পর্যটকের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন আরেক তরুণ রবিউল আলম। সকাল ১০টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় তিনিও এক টাকা আয় করতে পারেননি। রবিউল (২২) বলেন, আগে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে দৈনিক দু-তিন হাজার টাকা আয় হতো। ১০-১৫ দিন ধরে ৫০ থেকে ১০০ টাকাও আয় হয়নি। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঘোড়াকেও ঠিকমতো খাবার খাওয়ানো যাচ্ছে না। অভুক্ত থেকে ঘোড়াগুলো দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। প্রতিটি ঘোড়ার খাবারের পেছনে দৈনিক খরচ যায় ৪০০ টাকা করে।
সৈকতের কলাতলী, সুগন্ধা, সিগাল ও লাবণী পয়েন্টে পর্যটকদের ঘোরানের জন্য ঘোড়া আছে ৩৫টি। অধিকাংশ ঘোড়া অভুক্ত থেকে ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়েছে। গত শনিবার বিকেলে সিগাল সড়কের ড্রেনে পড়ে তিন বছর বয়সী একটি মাদি ঘোড়ার মৃত্যু হয়েছে। ঘোড়াটির ছয় মাস বয়সী একটি বাচ্চাও আছে।
ঘোড়ার মালিক কলাতলীর বাসিন্দা মো. লিটন বলেন, তাঁর তিনটি ঘোড়া রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিদিন দুটি ঘোড়া সৈকতে নামানো হয়, কিন্তু পর্যটক না থাকায় ১০০ টাকাও আয় হচ্ছে না। আয়রোজগার না থাকায় ঘোড়াকে ঠিকমতো একবেলা খাওয়ানো যাচ্ছে না। তা ছাড়া ভাঙাচোরা-লন্ডভন্ড সৈকতে ঘোড়া দৌড়ানোর জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
প্রতিটি ঘোড়া কিনতে ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা খরচ হয়েছে জানিয়ে কক্সবাজার সৈকত ঘোড়া মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহসানুল হক বলেন, পর্যটক চড়ানোর জন্য সৈকতে ঘোড়া আছে ৫০টি। এর মধ্যে সৈকতে নামানো হয় ৩৫টি ঘোড়া। কিন্তু পর্যটক না থাকায় ঘোড়াগুলো অলস পড়ে থাকে। দুই বছর আগেও ঘোড়া ছিল ৬৫টি। অভুক্ত থেকে অসুস্থ হয়ে বেশ কয়েকটি ঘোড়া মারা গেছে। বর্তমানে কিছু মালিক ১২-১৫টি অভুক্ত ঘোড়া ছেড়ে দিয়েছেন। খাবারের সন্ধানে ঘোড়াগুলোকে শহরের বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে ঘুরতে দেখা যায়। সড়কের পাশে এবং নালাতে জমে থাকা পলিথিন, প্লাস্টিক বর্জ্য খেয়ে কয়েকটি ঘোড়া অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
আহসানুল হকের ঘোড়া আছে সাতটি। গত সাত দিনে সাতটি ঘোড়া থেকে এক হাজার টাকাও আয় হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, তাতে সাতজন কর্মচারীর বেতন দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে দৈনিক যা আয় হয়, তার ৩০ শতাংশ পান কর্মচারীরা। অর্থাৎ একটি ঘোড়া থেকে এক হাজার টাকা আয় হলে কর্মচারী পান ৩০০ টাকা।
ঘোড়া মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদা বেগমের ঘোড়া আছে দুটি। দুটি ঘোড়া প্রতিদিন সৈকতে নামানো হলেও আয় নেই। দৈনিক খাবার জোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে জানিয়ে ফরিদা বেগম বলেন, গত ১৫ জুলাই থেকে কক্সবাজারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। এরপর গণপরিবহন চলাচল বন্ধ হলে ভ্রমণে আসা পর্যটকেরা গন্তব্যে ফিরে যান। সাম্প্রতিক ভারী বর্ষণ ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে সৈকতের পাঁচ কিলোমিটার ভেঙে লন্ডভন্ড হয়েছে। ফলে ঘোড়া নিয়ে মালিক-কর্মচারীদের বিপাকে পড়তে হচ্ছে। সৈকতে পর্যটকের সমাগম না ঘটলে অভুক্ত থেকে বহু ঘোড়ার মৃত্যু হতে পারে।
কক্সবাজার হোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ বলেন, পর্যটক না থাকায় দেড় মাস ধরে সৈকত এলাকার পাঁচ শতাধিক হোটেল-গেস্টহাউস রিসোর্ট ও কটেজ খালি পড়ে আছে, প্রতিদিন কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। হোটেল কক্ষভাড়ার বিপরীতে ৬০ শতাংশ ছাড় দিয়েও পর্যটক টানা যাচ্ছে না। হোটেল রেস্তোরাঁর পাশাপাশি সৈকত এলাকার তিন হাজারের বেশি দোকানপাট বন্ধ আছে। কিছু দোকান খুললেও তাতে বেচাবিক্রি মোটেও নেই।
পরিবেশবাদী সংগঠন কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আয়াছুর রহমান বলেন, পর্যটন মৌসুমে যখন সমুদ্রসৈকত লাখো পর্যটকে ভরপুর থাকে, তখন প্রতিটি ঘোড়া থেকে মালিকপক্ষ আয় করেন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। আয়রোজগার কমে গেলে মালিকেরা ঘোড়াগুলোকে ঠিকমতো খাবার দেন না। অভুক্ত ঘোড়াগুলো মাঠঘাটে ছেড়ে দেন। বিষাক্ত বর্জ্য খেয়ে অবুঝ প্রাণীগুলো বাঁচার চেষ্টা করে। প্রাণীগুলোর সুরক্ষায় সুষ্ঠু নীতিমালাও নেই।