রক্তদানের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ও মানুষকে রক্তদানে উৎসাহিত করার জন্য প্রচারণা চালায় এসব সংগঠন
ছবি: সংগৃহীত

পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার পাড়েরহাটের জেলেপল্লির বাসিন্দা ইতি মালোর (১৯) রক্তে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি আছে। এ সময় চিকিৎসক জানান, জরুরি তাঁকে চার ব্যাগ রক্ত দিতে হবে। হঠাৎ করে মেয়ের জন্য এত রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন দরিদ্র জেলে সুদেব মালো। পরে স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে সুদেব মালো পিরোজপুর শহরের অমিতাভ গুহ নামের এক রক্তদাতার ব্যাপারে জানতে পারেন। অমিতাভ গুহ স্বেচ্ছায় রক্ত দেন এবং রক্তাদাতা খুঁজে দেওয়ার কাজও করেন।

গত ২৮ মার্চ ইতি মালোকে নিয়ে তাঁর বাবা অমিতাভ গুহর কাছে যান। গত সাত মাসে ইতি মালোকে অমিতাভ গুহ ১৭ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে দেন আর ইতির স্বজনেরা জোগাড় করেন ২ ব্যাগ। গত অক্টোবরেই ইতিকে তিন ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে। অমিতাভ নিজেও একবার রক্ত দিয়েছেন।

অমিতাভ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইউনিটি ব্লাড ব্যাংক ফাউন্ডেশনের পিরোজপুর জেলা শাখার উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। পিরোজপুরে ওই সংগঠনের ৮১ জন সদস্য রয়েছেন। এ ছাড়া পিরোজপুরে প্রাণফোঁটা ও রক্তের বন্ধন নামে আরও দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছে। এসব সংগঠনের সদস্যরা মুমূর্ষু রোগী ও থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়মিত রক্তদান করে আসছেন। রক্তদানের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ও মানুষকে রক্তদানে উৎসাহিত করার জন্য প্রচারণা চালায় এসব সংগঠন।

স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতাদের নিয়ে পিরোজপুরে ২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সাংগঠনিকভাবে কাজ শুরু করে প্রাণফোঁটা। এই সংগঠনের প্রধান উদ্যোক্তা ম. শহিদুল্লাহ (৩২)। সংগঠন প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্প জানালেন শহিদুল্লাহ। তিনি যখন স্নাতকের ছাত্র ছিলেন তখন প্রতিবেশী এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর অস্ত্রোপচারের জন্য ও পজিটিভ রক্তের প্রয়োজন ছিল। আশপাশের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও রক্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা থেকে চার ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে রক্ত দিতে এসেছিলেন ওই নারীর এক আত্মীয়। এ ঘটনার পর স্থানীয়ভাবে রক্তদাতাদের নিয়ে সংগঠন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। পরে পাঁচ বন্ধুকে নিয়ে গড়ে তোলেন প্রাণফোঁটা। স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠনটির স্লোগান ঠিক করা হয় ‘প্রাণের পাশে সব সময়’।

পিরোজপুর শহরের একটি রোগনির্ণয়কেন্দ্রে স্বেচ্ছায় রক্তদান করছেন এক তরুণ
ছবি: সংগৃহীত

শহিদুল্লাহ বলেন, ‘গত সাড়ে আট বছরে প্রায় সাড়ে সাত হাজারের বেশি রোগীর জন্য রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েছি আমরা। পরে আমাদের জেলায় আরও কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংগঠন গড়ে উঠেছে।’
২০১৭ সালের ১৪ জুন রক্তের বন্ধন নামে আরও একটি রক্তদাতা সংগঠন পিরোজপুরে কার্যক্রম শুরু করে। এই সংগঠনে রয়েছেন ৩৫ জন স্বেচ্ছাসেবক। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মো. ফরহাদ গাজী বলেন, ‘প্রতিদিনই আমাদের কাছে রক্তের জন্য মানুষ আসেন। আমরা নিজেরা জোগাড় করে দিই। না পারলে অন্য রক্তদাতা সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিই। জেলার আশপাশের এলাকাগুলো থেকেও রক্তের জন্য মুঠোফোনে কল আসে। থ্যালাসেমিয়া ও অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর পাশাপাশি অস্ত্রোপচারের সময়ে রক্তের প্রয়োজন হলে আমাদের কাছে রোগীর স্বজনেরা আসেন।’

২০১৬ সালের ১৯ মার্চ থেকে ইউনিটি ব্লাড ব্যাংক ফাউন্ডেশন ঢাকায় কার্যক্রম শুরু করে। ২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর সংগঠনটি পিরোজপুর জেলায় কার্যক্রম সম্প্রসারণ করে। সংগঠনের সদস্যরা শুধু নিজেরাই নিয়মিত রক্ত দেন না, অন্যদেরও রক্তদানে উৎসাহিত করেন।

সহায়তা পাওয়া ব্যক্তিদের কথা

পিরোজপুর পৌরসভার রানীপুর মহল্লার মো. রাকিব (৮)। চার বছর বয়সে রাকিবের থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে। গেল তিন বছর ধরে প্রতি মাসে রাকিবকে দুই ব্যাগ রক্ত দিতে হতো। তবে এক বছর ধরে প্রতি মাসে তার এক ব্যাগ প্রয়োজন। রাকিবের জন্য নিয়মিত রক্তদাতা জোগাড় করে দেয় রক্তের বন্ধন।

রাকিবের বাবা মহসিন হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলের থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ার পর রক্ত জোগাড় করা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। পরে রক্তের বন্ধন সংগঠনটির কথা জানতে পেরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এর পর থেকে আমাকে আর রক্তের চিন্তা করতে হয়নি।’

পিরোজপুরের সিভিল সার্জন হাসনাত ইউসুফ বলেন, পিরোজপুরে বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতাদের  সংগঠন রয়েছে। রক্তের প্রয়োজনে রোগীদের জন্য এসব সংগঠন ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে। জরুরি প্রয়োজনের সময় সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে সহজেই রক্তদাতা পাওয়া যাচ্ছে। মানুষের জীবন বাঁচাতে রক্তদাতা সংগঠনগুলোর উদ্যোগ অনুসরণীয়।