বেড় জালে দেশি মাছ ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে

বেড় জালে সব ধরনের ছোট মাছ, পোনা, রেণু ও জলজ প্রাণী ধ্বংস হয়। তাই এই জালের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে সরকার।

রাত হলেই নিষিদ্ধ ‘বেড় জাল’ দিয়ে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয় মাছ ধরা। নৌকায় জাল নিয়ে জেলেরা মাছ ধরতে নামেন। এই জালে মাছের ডিম, রেণু পোনাসহ সব জলজ প্রাণী উঠে আসে। এতে হাওরে মাছের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে ও অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। পাশাপাশি এই অবৈধ জাল ব্যবহার করায় ধ্বংস হচ্ছে শামুক, ঝিনুক, জলজ পোকাসহ সব প্রকার জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ ও হাওরের প্রতিবেশ।

মৎস্য বিভাগ, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হাকালুকি হাওরের আয়তন ১৮ হাজার হেক্টর। এটি মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলা নিয়ে বিস্তৃত। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা এবং সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে পড়েছে হাওর।

মিঠাপানির বৃহত্তর এই হাওরটি একসময় দেশীয় বিভিন্ন ধরনের মাছসহ জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদে সমৃদ্ধ ছিল। হাওর ভরাট ও অবাধে জলজ সম্পদ আহরণের কারণে হাওরটি আর আগের সেই সমৃদ্ধ অবস্থায় নেই। হাকালুকি হাওর এখন প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ)। এদিকে এবার অকাল বন্যার ভাসান পানিতে হাওর থেকে বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম, এমন অনেক মাছের দেখা মিলছে। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এবার মাছের সহজলভ্যতার কারণে জেলেরাও খুশি।

এ পরিস্থিতিতে একসঙ্গে সহজে বেশি মাছ ধরতে গিয়ে ব্যবহার করছেন নিষিদ্ধ বেড় জাল বা কোনা বেড় জাল, কারেন্ট জাল ইত্যাদি। এসব অবৈধ জাল ব্যবহারকারীরা দিনের বেলা মাছ ধরতে হাওরে নামেন না। সন্ধ্যার পর কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জের বিভিন্ন প্রান্ত দিয়ে হাওরে মাছ ধরতে নামেন। সারা রাত মাছ ধরেন। বিশাল একেকটি বেড় জালের সঙ্গে অনেক জেলে যুক্ত থাকেন। তাঁরা হাওরের অভয়াশ্রমেও অবৈধভাবে মাছ ধরেন।

বেড় জালের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এই জালে বড় মাছের পাশাপাশি মাছের ডিম, পোনা, রেণু, ছোট পোনা মাছ, শামুক, ঝিনুক, পোকাসহ সব ধরনের জলজ প্রাণী, শাপলা, শালুক, শেওলাসহ জলজ উদ্ভিদ উঠে আসে। এতে মাছের প্রজনন ও উৎপাদন দুটোই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যেসব মাছ হাওরে ফিরে আসতে দেখা যাচ্ছে, সেগুলোও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। হাকালুকি হাওরে মাছের উৎপাদন কমছে। অন্যান্য জলজ প্রাণীও ধ্বংস হয়ে হাওরের প্রতিবেশ নষ্ট হচ্ছে।

হাওরে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে মাছ ধরা বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন সময় পুলিশের সহযোগিতায় স্থানীয় প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগ অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল ও নৌযান–সংকটের কারণে মৎস্য বিভাগের পক্ষে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয় না।

গত মঙ্গলবার বড়লেখা উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশি প্রজাতির মাছসহ অভয়াশ্রম রক্ষা, বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ পুনরায় হাকালুকিতে ফিরিয়ে আনতে সব কটি উপজেলা একসঙ্গে অভিযানে নামতে পারলে এবং অবৈধ জাল ব্যবহার বন্ধ করা গেলে, যেসব প্রজাতির মাছ আগে পাওয়া যেত, সেগুলো আবার পাওয়া যাবে।’

মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মৎস্য আইনে নিষিদ্ধ বেড় জাল ব্যবহারে সর্বনিম্ন এক বছর ও সর্বোচ্চ তিন বছর জেল এবং সর্বনিম্ন¤পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে।

স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার হাকালুকি হাওরের বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়নের পলোভাঙা অভয়াশ্রমে বড়লেখা উপজেলা প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ ও পুলিশ যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে দুটি নৌকাসহ দুটি বেড় জাল জব্দ করা হয়। দুটি বেড় জালের দৈর্ঘ্য প্রায় তিন হাজার হাত। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ১০ লাখ টাকা। এ সময় ১৮ জন জেলেকে আটক করা হয়। তাঁদের প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা করে মোট ৯০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

গত সোমবার বিকেল পাঁচটা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে অংশ নেন বড়লেখার ইউএনও খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী, উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান, এসআই নজরুল ইসলাম প্রমুখ।

ইউএনও খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী মঙ্গলবার বলেন, ‘আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করি। গত সোমবারও অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। আশা করছি, এতে সবাই সতর্ক হবে। আমাদের অভিযান ও নজরদারি অব্যাহত থাকবে।’